চিনিকলে লোকসানের কারণ অনুসন্ধানে তদন্ত কমিটি গঠনের দাবি

সরকারি চিনিকলগুলোর লোকসানের প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান ও দায়ীদের চিহ্নিত করার জন্য বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে তদন্ত কমিশন গঠন করাসহ সাত দফা দাবি জানিয়েছে ‘জাতীয় নাগরিক সমন্বয় কমিটি’ নামে একটি প্ল্যাটফর্ম।

রবিবার (২৯ ডিসেম্বর) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) নসরুল হামিদ মিলনায়তনে এসব দাবি জানানো হয়। রংপুর চিনিকল চালু করার নামে গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতালদের ভূমি কেড়ে নেওয়ার প্রতিবাদে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে ১০টি সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত জাতীয় নাগরিক সমন্বয় কমিটি। কমিটির অন্তর্ভুক্ত সংস্থাগুলো হলো– এএলআরডি, নিজেরা করি, ব্লাস্ট, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন, অর্পিত সম্পত্তি আইন প্রতিরোধ আন্দোলন, জাতীয় আদিবাসী পরিষদ, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ ও সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটি।

এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, ‘দশকের পর দশক ধরে বিপুল পরিমাণ লোকসানের ভারে নুয়ে পড়া ও বন্ধ চিনিকলগুলো চালুর উদ্যোগ সংক্রান্ত একটি সরকারি সিদ্ধান্তের তথ্য সম্প্রতি আমরা জেনেছি। বর্তমানে দেশে সরকারি চিনিকলের সংখ্যা ১৫টি। এর মধ্যে তিনটি ব্রিটিশ আমলে, ৯টি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আমলে এবং তিনটি বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্থাপিত হয়। তবে এই ১৫টির মধ্যে চালু আছে ৯টি। বাকি ছয়টি আখের সংকট ও লোকসানের কারণ দেখিয়ে কয়েক বছর আগে বন্ধের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা সরকারের পক্ষ দেওয়া হয়।’

তিনি বলেন, সরকারি চিনিকলগুলোতে লোকসানের প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান ও দায়ীদের চিহ্নিত করার জন্য বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী ও স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠনের জন্য সরকারকে আহ্বান করছি। এই তদন্ত কমিশন খুঁজে বের করবে সরকারি চিনিকলগুলো কেন বছরের পর বছর এত বিপুল পরিমাণ লোকসান দিচ্ছে। কাদের কারসাজি, দুরভিসন্ধি ও স্বার্থ এই লোকসানের পেছনে ভূমিকা পালন করেছে।’

নিজেরা করির সমন্বয়কারী খুশী কবির বলেন, ‘আমরা সার্বিক চিত্রটি দেখতে চাই, কোনটা বেশি জরুরি? চিনিকল নাকি অন্য কোনও ফসল। অনেক বছর ধরে চিনিকলগুলো অকার্যকর। সেগুলো জমি দখল করে রেখেছে। আমরা সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছি বিষয়টি দেখার জন্য। তবে এখনই আমরা কোনও আইনি পদক্ষেপের দিকে যাচ্ছি না।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, ‘গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতালদের জমি দখল করে যে অলাভজনক চিনিকল বন্ধ রয়েছে, সেটি চালু না করে তাদের ভূমি ফিরিয়ে দিতে হবে। ওই জমি তিন ফসলি। এমন জমিতে কারখানা না করার নীতমালা রয়েছে।’

তাদের সাত দফা দাবি হলো–

১. বন্ধ চিনিকলগুলো চালু করা আদৌ লাভজনক কিনা তার সম্ভাব্যতা যাচাই করতে বিশেষজ্ঞ দল নিয়োগ করে তাদের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব ও সুপারিশ বিবেচনায় নিয়েই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তার আগে কোনও বন্ধ চিনিকল চালু করা ঠিক হবে না।

২. সরকারি চিনিকলগুলোর লোকসানের পেছনের প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান ও দায়ীদের চিহ্নিত করার জন্য বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী ও স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করতে হবে।

৩. উপর্যুক্ত কাজ সম্পন্ন হওয়ার আগ পর্যন্ত বন্ধ চিনিকল চালুর সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের ঘোষণা দিতে হবে।

৪. চিনিকল চালুর জন্য গঠিত দুর্নীতিগ্রস্ত আমলানির্ভর টাস্ক ফোর্স বাতিল করে দেনার দায়ে জর্জরিত চিনিকলের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনকে সংস্কার-প্রতিস্থাপন করে দেশের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক চাহিদার নিরিখে খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের উন্নয়ন কীভাবে ঘটানো যায়, তার প্রস্তাবনার জন্য বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি সংস্কার কমিশন গঠন করতে হবে।

৫. গোবিন্দগঞ্জের বাগদা ফার্মের রিকুইজিশন করা জমি আখ চাষের নামে নেওয়া হলেও বিগত প্রায় দুই দশক ওই কাজে ব্যবহৃত হয় না। তাই তিন ফসলি ১৮৪২ দশমিক ৩০ একর কৃষিজমি মূল সাঁওতাল মালিকদের উত্তরাধিকারী ও তাদের পরিবার পরিজন এবং অন্যান্য আদি-বাঙালি কৃষক পরিবারের কাছে অবিলম্বে হস্তান্তর করতে হবে। এই বিষয়ে কোনও গড়িমসি চলবে না।

৬. ৬ নভেম্বর ২০১৬ সালে সাঁওতাল পল্লীতে হামলাকারী, অগ্নিসংযোগকারী, লুটপাটকারী পুলিশের একাংশসহ অভিযুক্ত সবাইকে অবিলম্বে গ্রেফতার করে বিচার ও শান্তির আওতায় আনতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।

৭. ওই সময় গোবিন্দগঞ্জে শ্যামল হেমব্রম, মঙ্গল মার্ডি ও রমেশ টুডুকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয়। এই হত্যার জড়িতদের গ্রেফতার এবং আইন অনুযায়ী দ্রুত বিচার করতে হবে।

সংবাদ সম্মেলনে আরও ছিলেন– সুপ্রীম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী তবারক হোসাইন, সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, আইনজীবী রেজাউল করিম, গাইবান্ধা জজ কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট সিরাজুল ইসলাম বাবু।