উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার একটি দিন

সরকারের শীর্ষ প্রশাসনিক দফতর বাংলাদেশ সচিবালয়ে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারী থেকে শুরু করে সরকারের সর্বত্র পুরো একটি দিন কেটেছে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায়। দেশের সাধারণ নাগরিকসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের মনেও ছিল উদ্বেগ। নানা কৌতূহলে কেটেছে পুরোটা সময়। বুধবার (২৫ ডিসেম্বর) দিবাগত রাত ১টা ৫২ মিনিটে  সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনে লাগা আগুনে পুড়ে গেছে সরকারের কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ ফাইল, নথিপত্রসহ পুরো অবকাঠামো। আগুনের পাশাপাশি কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলীতে ছেয়ে যায় পুরো সচিবালয় এলাকা। মূলত এ কারণেই ছিল উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এসব তথ্য। 

জানা গেছে, ফায়ার সার্ভিসের ২০টি ইউনিট কাজ করে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে। এ সময় ট্রাকের নিচে চাপা পড়ে মারা যায় ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মী। ফায়ার সার্ভিসকে সহযোগিতা করে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও এপিবিএন সদস্যরা। সরকারের প্রায় সব উপদেষ্টা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। ঘটনা তদন্তে সরকারের পক্ষ থেকে কমিটি গঠন করা হয়েছে। তবে নৌবাহিনীর দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেছেন, ‘এটি নাশকতা।’ বড়দিন উপলক্ষে ২৫ ডিসেম্বর সরকারি ছুটি কাটানোর পরের দিন বৃহস্পতিবার সকাল ৯টার আগেই অফিস করার জন্য কর্মকর্তা কর্মচারীরা সচিবালয়ে এসে পৌঁছালেও ভেতরে প্রবেশ করতে পারেনি সকাল সোয়া ১০টা পর্যন্ত। ফায়ার সার্ভিস ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য ছাড়া সচিবালয়ের ভেতরে দর্শনার্থীসহ কোনও সাংবাদিককে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি।   

সূত্র জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার পুরো দিন সচিবালয়ের অভ্যন্তরের অপর ভবনগুলোতে অবস্থিত মন্ত্রণালয় বা বিভাগেও কোনও কাজকর্ম হয়নি। এর প্রভাব ফেলেছে দেশের বিভিন্ন বিভাগীয় এবং জেলা, উপজেলা প্রশাসনেও। বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে সরকারের শীর্ষ মহলকে। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনও। বিচ্ছিন্নভাবে উপদেষ্টারা বলেছেন, এ ঘটনায় বর্তমান সরকারকে ব্যর্থ প্রমাণ করতে চাইছে একটি মহল। এটি তাদেরই কাজ। তাদের কোনোভাবেই ছাড় দেওয়ার সুযোগ নাই।

সচিবালয়ের ৬ নম্বর ভবনের ষষ্ঠ তলায় শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। সপ্তম তলায় স্থানীয় সরকার বিভাগ, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ। অষ্টম তলায় স্থানীয় সরকার বিভাগের কিছু অংশ এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের কিছু অংশ।

মধ্যরাতে এভাবেই পুড়তে থাকে সচিবালয়ের ভবনটি (ছবি: সংগৃহীত)

জানা গেছে, ৭ নম্বর ভবনের ছয় তলায় আগুন লাগে। পরে তা ছড়িয়ে পড়ে একই ভবনের ৭, ৮ ও ৯ তলায়। খবর পেয়ে এর পরপরই ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আগুন নেভানোর কাজে যুক্ত হয়। প্রথমে সচিবালয়ে অবস্থিত ফায়ার সার্ভিসের ইউনিটটি আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে রাত ১টা ৫৪ মিনিট থেকে। এর কয়েক মিনিটের মাথায় আগুনের তীব্রতা বেড়ে যাওয়ায় পর্যায়ক্রমে ১৮টি ইউনিট ঘটনাস্থলে আসে। পরে আরও দুটি ইউনিট বাড়ানো হয়। মোট ২০টি ইউনিট কাজ করে ৬ ঘণ্টারও বেশি সময় পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। প্রাথমিকভাবে আগুন লাগার কারণ ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানাতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস।

এদিকে বৃহস্পতিবার (২৬ ডিসেম্বর) বাংলাদেশ সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন অন্তর্বর্তী সরকারের স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। তিনি বলেন, ষড়যন্ত্রকারীরা থেমে নেই। আমাদের (সরকার) ব্যর্থ করার এই ষড়যন্ত্রে যে বা যারাই জড়িত থাকবে, তাদের বিন্দু পরিমাণ ছাড় দেওয়া হবে না। তিনি সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে উত্তরবঙ্গের নির্ধারিত কর্মসূচি স্থগিত করে সকালে ঢাকায় ফিরে আসেন। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা প্রসঙ্গে উপদেষ্টা বলেন, ‘স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের বিগত সময়ে হওয়া অর্থ লোপাট, দুর্নীতি নিয়ে আমরা কাজ করে যাচ্ছিলাম। কয়েক হাজার কোটি টাকা লুটপাটের প্রমাণও পাওয়া গিয়েছিল।’

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সচিবালয়ের সাত নম্বর ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের জেলা ও মাঠ প্রশাসন অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ খালেদ রহীমকে প্রধান করে ৭ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে সরকার। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত অফিস আদেশ জারি করা হয়েছে। কমিটিতে যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগ এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের একজন করে প্রতিনিধি রাখা হয়েছে। এছাড়াও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ এবং ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের দুই জন প্রতিনিধি থাকবেন। কমিটিতে সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করবেন গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি। কমিটির কার্যপরিধি উল্লেখ করে বলা হয়েছে, এই কমিটি সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডের ‘উৎস ও কারণ’ উদ্ঘাটন; অগ্নিদুর্ঘটনার পেছনে কারও ব্যক্তিগত বা পেশাগত দায়দায়িত্ব আছে কিনা, তা উদঘাটন এবং এ জাতীয় দুর্ঘটনা প্রতিরোধকল্পে সুপারিশ প্রণয়ন করবেন। কমিটিকে আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

সচিবালয়ে আগুন লাগার ঘটনা দেখতে সরেজমিন বৃহস্পতিবার সকালেই আসেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। সকাল ৯টায় সচিবালয়ের সামনে এক ব্রিফিংয়ে তিনি জানান, এই ভয়াবহ আগুনের ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জানান, সকাল ৮টা ৫ মিনিটে আগুন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আসে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘তদন্ত করার আগে আমরা এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে পারবো না।’

নিহত ফায়ার ফাইটার সোয়ানুর জামান নয়নকে শ্রদ্ধা জানান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাসহ ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা

সচিবালয়ের আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পরে সরজমিন পরিদর্শন করে দেখা গেছে, ৭ নম্বর ভবনের ৬ থেকে ৯ তলা পর্যন্ত চারটি ফ্লোর পুরোটা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এই চার তলায় কিছুই অবশিষ্ট নেই। ছাই হয়ে যাওয়া চারটি ফ্লোরে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ, স্থানীয় সরকার বিভাগ, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ এবং সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ ছিল। ফ্লোরগুলো একেবারে পুড়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, আগুন পুরোপুরি নেভাতে সময় লাগে ১০ ঘণ্টা।

এদিকে ঘটনা দেখতে বৃহস্পতিবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সচিবালয়ে আসেন নৌপরিবহন উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন, পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় এবং যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। আসিফ মাহমুদ ও সাখাওয়াত হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের সব শেষ হয়ে গেছে।

ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (ডিপিডিসি) রমনা জোনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মহসীন আব্দুল্লাহ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আগুন লাগার কারণে নিরাপত্তার স্বার্থে আমরা বিদ্যুৎ বিতরণ বন্ধ করেছি। আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা অনেক পানি ছিটিয়েছেন। এতে অনেক কক্ষের আসবাবপত্রসহ সব কিছু ভেজা অবস্থায় রয়েছে। এতে বিদ্যুৎ সংযোগ দিলে আবারও দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তাই গণপূর্ত অধিদফতর পিডব্লিউডি ও বিদ্যুৎ বিভাগের লোকজন এখন সেখানে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজ শুরু করেছে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার পর বিদ্যুৎ লাইন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আবার সংযোগ দেওয়া হবে।’

সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বলেছে, দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা কিংবা কেপিআইয়ে হামলা-নাশকতা প্রতিরোধ এবং নিরাপত্তা বিষয়ে অন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে সেনাবাহিনী। অন্য বাহিনীগুলোর সঙ্গে এ বিষয়ে নিয়মিত পর্যালোচনা করা হয় বলে জানিয়েছেন সেনা সদরের কর্নেল-স্টাফ কর্নেল ইন্তেখাব হায়দার খান। তিনি বলেন, ‘সচিবালয়ে আগুনের ঘটনা তদন্ত হবে। তদন্ত হলে আগুন লাগার কারণ জানা যাবে।’ বৃহস্পতিবার (২৬ ডিসেম্বর) দুপুরে ‘ইন এইড টু সিভিল পাওয়ারের’ আওতায় মোতায়েন করা সেনাবাহিনীর কার্যক্রম সম্পর্কিত প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি এসব কথা বলেন।

নয়নের জানাজা শেষে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

আগুনে কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা এখনও জানা যায়নি বলে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। এতে বলা হয়, ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ ও অগ্নিকাণ্ডের কারণ উদ্ঘাটনে মন্ত্রণালয়ভিত্তিক পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

সচিবালয়ে লাগা আগুন শর্টসার্কিটে নয়, বরং পরিকল্পিতভাবে কেউ হয়তো লাগিয়েছে বলে মনে করছেন বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সিনিয়র চিফ পেটি অফিসার আমিনুল ইসলাম। বৃহস্পতিবার (২৬ ডিসেম্বর) সকালে সচিবালয়ের ভেতরে পরিদর্শন শেষে বেরিয়ে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘ভেতরের পরিস্থিতি দেখে ধারণা করছি, কোনও শর্টসার্কিট থেকে আগুন লাগেনি। বিভিন্ন স্থান থেকে আগুনটা লেগেছে বলে আমাদের প্রাথমিক ধারণা।’

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দেশের একাধিক বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছেন, ‘এটি সাধারণ ঘটনা নয়। বিষয়টি সরকারকে কঠোরভাবে মনিটর করতে হবে। দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও নথিপত্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এটি করা না হলে সরকারের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা কঠিন হবে।’

এ বিষয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে বিবৃতি দেওয়া হয়েছে। বিবৃতিতে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘সচিবালয়ের মতো স্পর্শকাতর ভবনে ভয়াবহ আগুন এবং একজনের মৃত্যু ও ২-৩ জন আহত হওয়ার ঘটনায় আমি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। সচিবালয়ে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র পুড়ে ভস্মীভূত হওয়ায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের এ ধরনের অগ্নিকাণ্ডে বিব্রতকর অবস্থায় পড়া অস্বাভাবিক নয়।’