কবি ও ভাবুক ফরহাদ মজহার বলেছেন, ‘আমি মনে করি, গণঅভ্যুত্থানের পর এখানে একটি প্রতিবিপ্লব হয়েছে। আমার ভাষায় যেটাকে বলি সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লব। গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে গণঅভিপ্রায় ব্যক্ত হয়েছে– আইনের নামে, সংবিধানের নামে সেটিকে নস্যাৎ করে দেওয়া হয়েছে। এটি হয়েছে মূলত মধ্যবিত্ত শ্রেণির, মানে এলিট শ্রেণির জন্য। এলিট শ্রেণি আইনের নামে জনগণের যে গণআকাঙ্ক্ষা, যে অভিপ্রায় সেটিকে টুঁটি চেপে শুরুতেই এটাকে নষ্ট করে দিয়েছে। পুরো গণঅভ্যুত্থানকে ঢুকিয়েছে আমাদের তথাকথিত সংবিধানে।’
শুক্রবার (৮ নভেম্বর) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুজাফফর আহমদ চৌধুরী মিলনায়তনে ‘দেয়ালে আঁকা নতুন বাংলাদেশ’ শিরোনামে ভাববৈঠকির আয়োজনে ‘গ্রাফিতিতে ৩৬ জুলাই’ অনুষ্ঠানে ফরহাদ মজহার এসব কথা বলেন।
এর আগে সাংবাদিক ও গবেষক মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান তোলা ‘দেয়ালে আঁকা নতুন বাংলাদেশ’ গ্রাফিতিতে ৩৬ জুলাই ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় দেয়ালে আঁকা গ্রাফিতি উপস্থাপন করেন। এতে তিনি জুলাইয়ের কোটা আন্দোলন থেকে শুরু করে ছাত্র আন্দোলন, ছাত্র-জনতার আন্দোলন, এক দফা আন্দোলন, সরকার পতন এবং আন্দোলন জেনারেশন ‘জেড’ বা ‘জেএনজি’র চিন্তা-চেতনা ও নতুন বাংলাদেশের বিভিন্ন দেয়ালচিত্র বা দেয়াল গ্রাফিতি তুলে ধরেন।
গ্রাফিতির তাৎপর্য নিয়ে ফরহাদ মজহার বলেন, ‘বাংলাদেশের এই আন্দোলনের সময়ের গ্রাফিতিগুলোর তাৎপর্য কী? দুটি দিক আমি জানি। এর একটি অংশ লেখা হয়েছে- আন্দোলন চলমান, যখন গুলি হয়েছে। তার মধ্যে লেখা হয়েছে। আরেকটি হচ্ছে রিফলেকটিভ, যেটি ঘটে গেছে। যেগুলো গলির মধ্যে লেখা হয়েছে, তার একটা তাৎপর্য আছে। আর পরে যেগুলো লেখা হয়েছে সেটার আরেকটা তাৎপর্য। এই ধরনের পরিস্থিতিতে, যখন একটা ফ্যাসিস্ট রেজিম আছে, সে আপনার ওপর দমন-পীড়ন করছে। সেই পরিস্থিতিতে গ্রাফিতি মাত্রই একটা প্রতিরোধের ভাষা। সে ভাষা পৌঁছাতে চায়। যে লিখছে, তবে সে নিজেও জানে লেখাটা কাকে পৌঁছাতে চায়! কিন্তু সে লেখাটা কারও কাছে পৌঁছাতে পারে আবার কারও কাছে পৌঁছাতে নাও পারে। ফলে সেই সমাজেও কিন্তু গ্রাফিতির মাধ্যম একটা মেরুকরণ ঘটায়। এটা একটা পলিটিকাল অ্যাক্ট। এজন্য গ্রাফিতির খুবই গুরুত্বপূর্ণ মর্যাদা রয়েছে। এটি আমাদের কাছে পৌঁছাতে চাইছে। যারা ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়ছে, গ্রাফিতি তাদের কাছে পৌঁছাতে চায়।’
গ্রাফিতি প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘এই গ্রাফিতি একই সঙ্গে কাউন্টার ন্যারেটিভ তৈরি করে। এই ন্যারেটিভ বিদ্যমান যে পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা বা যাকে আমরা পলিটিক্যাল ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থা বলি, তার বিরুদ্ধে একটা কাউন্টার ন্যারেটিভ তৈরি করে। শিল্প স্বভাবতই নতুন রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী তৈরি করে।’
জেরানেশন জেড বা জেএনজি নিয়ে ফরহাদ মজহার বলেন, ‘আমি জেএনজির ঘোর বিরোধিতা করি। এই জন্য নয় যে, জেএনজি সম্পর্কে আমার কোনও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নেই। এটি আসলে করপোরেট টার্ম। বড় বড় কোম্পানিগুলো এই শব্দ ব্যবহার করেছে। আমি জেএনজিকে সমর্থন করি। কিন্তু আইন এবং রাজনীতির সম্পর্ক বুঝতে হলে আপনাকে অবশ্যই পড়াশোনা করতে হবে। জেএনজি দ্বারা এটি হবে না।’
কিছু দাবি তুলে রেখে তিনি বলেন, ‘কয়দিন পর কিন্তু এসব দেয়াল মুছে ফেলা হবে। এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দুর্বল হবে। এই দেয়ালের গ্রাফিতিগুলো মোছা হয়ে যাবে। যদি এটি আমরা রাখতে চাই, তাহলে আমাদের এখনই দাবি রাখতে হবে, শহরের এই দেয়ালগুলো পৌরসভার দেয়াল নয়। এটি জনগণের দেয়াল।’
এ আয়োজনে আরও বক্তব্য দেন– ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম, সহযোগী অধ্যাপক সামিনা লুৎফা, শিল্পী ও শিক্ষক মুনেম ওয়াসিফ।