গত দুই-তিন দিন ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে বাংলাদেশিদের মধ্যে তুমুল বাক্যালাপ বা শব্দযুদ্ধ চলছে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন নিয়ে। যারা রাজনৈতিক আলাপে জড়াতে চান না, তাদের অনেকেও হয়তো একটা বাক্য লিখেছেন। ট্রাম্প নাকি কমলা––এটা নিয়ে বাংলাদেশের কি এমন প্রশ্নও তুলেছেন কেউ কেউ। কিন্তু এই বৈশ্বিক রাজনীতির লড়াইয়ে রিপাবলিকান নাকি ডেমোক্র্যাট, কারা ক্ষমতায় যাচ্ছে সেদিকে তাকিয়ে থাকে পুরা বিশ্ব। এখন প্রশ্ন হলো––কে এলে কার লাভ, আর ক্ষতি হতে পারে কার।
বাংলাদেশ সময় বুধবার (৬ নভেম্বর) দুপুর ১টার কিছু পরে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেকে বিজয়ী দাবি করেন। ফ্লোরিডায় নিজের নির্বাচনি প্রচারণার সদর দফতরে সমর্থকদের সামনে তিনি বক্তব্য রাখেন। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে খবরটি প্রচারের পরই ফেসবুকের ফিড ভরে ওঠে ট্রাম্প ও কমলার পক্ষ-বিপক্ষের স্ট্যাটাসে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসা ও বাংলাদেশে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার বিষয়ে বিশ্লেষণ করে স্ট্যাটাস দিয়েছেন সাংবাদিক আমীন আল রশীদ। তিনি লিখেছেন, “ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার ঝুঁকিতে পড়বে। কারণ ড. ইউনূসের ক্ষমতায় আসা এবং তার অব্যবহিত পূর্বে বাংলাদেশে সংঘটিত গণঅভ্যুত্থানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে সরকার সমর্থন দিয়েছে, তারা ডেমোক্র্যাটিক। ডোনাল্ড হচ্ছেন তার প্রতিদ্বন্দ্বী রিপাবলিকান। উপরন্তু ট্রাম্পের সঙ্গে ভারতের বর্তমান শাসকগোষ্ঠী বিজেপি তথা নরেন্দ্র মোদির সম্পর্ক ভালো। অতএব, বাংলাদেশে যেহেতু ভারতের বিরাট স্বার্থ রয়েছে এবং ভারতের পছন্দের শাসক হিসেবে পরিচিত শেখ হাসিনাকে উৎখাত করা হয়েছে ডেমোক্র্যাটিক সরকারের সমর্থনে, অতএব ট্রাম্প জিতে গেলে বাংলাদেশে ভারত নাক গলানোর সুযোগ পাবে, যা ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারকে বিপদে ফেলবে। এই হলো অঙ্ক এবং অনেকেই এই অঙ্ক বিশ্বাস করেন। গত বছরের ২৩ মে ডেইলি স্টারে লিখেছিলাম: ‘বিদেশিরা কি চাইলে সরকার ফেলে দিতে পারে?’ আবারও সেই প্রশ্ন করছি যে বাংলাদেশের সরকারে কে থাকবে বা কাকে উৎখাত করা হবে—সেটি কি বিদেশিরা মানে ভারত-আমেরিকা-চীন ঠিক করবে? যদি তাই হয় তাহলে এই দেশের ১৮ কোটি মানুষ এবং ১১ কোটি ভোটারের কী দরকার? পাঁচ বছর পর পর ওই তিন দেশ মিলে ঠিক করলেই তো হয় যে এবার বাংলাদেশে সরকার কে চালাবে- আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় পার্টি, অন্তর্বর্তী নাকি অন্য কেউ?”
নির্বাচনে তরুণ শক্তি গুরুত্ব পেয়েছে বিশ্লেষণ করে রাজনৈতিক কর্মী আশরাফ সিদ্দিকী বিটু লিখেছেন, “ট্রাম্পের রানিংমেট ভাইস প্রেসিডেন্ট-ইলেক্ট J.D Vance-এর বয়স ৪০ বছর। ট্রাম্পের ইলেকশন ক্যাম্পেইন গ্রুপে ৬০-এর বেশি বয়স দুজনের সঙ্গে communication director Huyen "Steven" Cheung-এর বয়স ৪২, adviser Brian Jack-এর বয়স ৩৬। সিনিয়র adviser Jason Miller-এর বয়স ৪৮/৪৯ বছর। Kamala Harris গ্রুপে একটু সিনিয়র বাট ৫০-এর কোটায় বেশি। these things matter, they all pay importance on young force.এই বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ, এগুলো সবই তরুণ শক্তির গুরুত্বের ইঙ্গিত দেয়।”
আমেরিকার নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশে লাভ-ক্ষতির আলাপ কেন? কারণ, এখন বিশ্ব রাজনীতিতে কেউ কারোর থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। শক্তিমান রাষ্ট্রগুলোর প্রভাব অপেক্ষাকৃত কম ক্ষমতাবান রাষ্ট্রগুলোর ওপর দৃশ্যমান। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা কয়েক দিন ধরে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বলছেন, কেন ভারতের জন্য ট্রাম্পের আগমন ইতিবাচক, আর সেটার সঙ্গে মিলিয়ে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিও বিবেচনা করা হচ্ছে।
বিগত বছরগুলোয় বন্ধু হয়ে উঠলেও শেষ চার বছরে ভারত-আমেরিকার মধ্যে নানা বিষয়ে ‘দূরত্ব’ তৈরি হয়েছে বলে জানাচ্ছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রে যে দলই ক্ষমতায় আসুক, পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন হয় না; কিন্তু ট্রাম্প বা কমলা এই দুই প্রার্থীর একেকজনের নীতি একেক রকম, সেটাও বিবেচনায় রাখতে হচ্ছে। এর আগে ট্রাম্পের শাসনামলে ভারতের সঙ্গে ওয়াশিংটনের সম্পর্ক বেশ ভালো থাকায় আগামীতে বেশ কিছু সম্ভাবনার কথা বলছেন তারা। তবে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি কোনদিকে যাবে তা বুঝতে কিছু দিন সময় নিতে হবে।
উচ্চ শিক্ষার্থে আমেরিকা প্রবাসী আসিফ বিন আলী তার ফেসবুকে লিখেছেন, “ট্রাম্প আমেরিকার পরবর্তী প্রেসিডেন্ট। আমেরিকায় থাকার সুবাদে এই ব্যাপারটা খানিক আগে থেকেই টের পাচ্ছিলাম। ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে আন্তর্জাতিক ক্ষমতা কাঠামো একটি বড় হুমকির মুখে পড়বে সন্দেহ নেই। তবে এই মুহূর্তে ট্রাম্পের রিপাবলিকান পার্টির ফরেন পলিসির প্রধান লক্ষ্য থাকবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, আরব-ইসরাইল অস্থিরতা। বাংলাদেশ সমস্যা অনেক অনেক পরে আলোচ্য বিষয় থাকবে ট্রাম্প প্রশাসনের। তবে এটা প্রায় বলা যায় ডোনাল্ড লু খেলার মাঠ থেকে বিদায় নেবেন। যেহেতু রিপাবলিকানদের সরাসরি আগ্রহ থাকবে না বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর, সেই শূন্যস্থানে ভারত তাদের হারানো প্রভাব পুনরুদ্ধারের সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে। মুহাম্মদ ইউনূস ইতোপূর্বে ব্যক্তিগতভাবে ট্রাম্পের সমালোচনা করেছেন। এটা ট্রাম্প কতটা ব্যক্তিগতভাবে নিয়েছেন তা জানি না। উল্লেখ্য, ইউনূস সরকারকে এখন নতুন বিশ্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কাজ করতে হবে। সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হবে আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দিয়ে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর। অন্যথায়, বর্তমান ঐক্য নিয়ে মনে হয় না সরকার আঞ্চলিক রাজনীতির গেমে সুবিধা করতে পারবে। আওয়ামী লীগের খুশি হওয়ার আপাতত কোনও কারণ নেই। তারা যদি মনে করে ট্রাম্প আসার কারণে তারা পুনরায় ক্ষমতায় ফিরতে পারবে তা আকাশ-কুসুম কল্পনা হবে। তবে এটা ঠিক, আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ফিরে আসার সুযোগ তৈরি হবে অদূর ভবিষ্যতে। আমেরিকার এই নির্বাচনের কারণে সবচেয়ে লাভবান হবে বিএনপি। কেননা নির্বাচন নিয়ে বিএনপি এখন আর বেশি চাপ দিতে পারবে, এবং হয়তো সরকার এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আগাম নির্বাচনের কথা ভাববে।”