৮৪ কোটি টাকার কেনাকাটায় দুর্নীতি

প্রতিবাদ করায় হয়রানির অভিযোগ প্রকল্প পরিচালকের বিরুদ্ধে

সরকারি কর্মচারী হাসপাতাল সম্প্রসারণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক জনপ্রশাসনমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনের সুপারিশে। নিয়োগ পেয়েই তিনি ৮৪ কোটি টাকার কেনাকাটার দরপত্র আহ্বান করেন। সেই দরপত্রে কারসাজি করে নিজের পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দেওয়ার সব ধরনের প্রস্তুতিও নিয়েছিলেন। কিন্তু বিষয়টি জানাজানি হলে দরপত্রে অংশ নেওয়া একটি প্রতিষ্ঠান অভিযোগ করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে। সেই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে প্রকল্প পরিচালককে বদলির আদেশও দেওয়া হয়। এরপরই ক্ষেপে যান তিনি। এখন ক্ষমতার অপব্যবহার করে সেই অভিযোগকারীকে পুলিশ দিয়ে হয়রানি করা শুরু করেছেন।

আলোচিত এই প্রকল্প পরিচালকের নাম সিদ্দিকুর রহমান। তিনি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা। গত ১৫ অক্টোবর তাকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হয়। কিন্তু বদলি আদেশের প্রায় দুই সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও তিনি প্রকল্প পরিচালকের পদ ছাড়েননি।

সংশ্লিষ্টরা জানান, মোটা অঙ্কের আর্থিক সুবিধার বিনিময়ে নিজের পরিচিত প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন প্রকল্প পরিচালক সিদ্দিকুর রহমান। বদলির আদেশ হলেও দরপত্রের কাজ শেষ করে প্রকল্প ছাড়ার জন্য মন্ত্রণালয়ে  দেনদরবারও করছেন তিনি। জানতে চাইলে যুগ্ম সচিব সিদ্দিকুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। দরপত্র এখনও মূল্যায়ন পর্যায়ে রয়েছে। আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে কোনও কিছু করা হবে না। পিপিআর অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়ার সুযোগও রয়েছে। আর ভেতরের খবর বাইরে থেকে জানারও কথা নয়।’ যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার এই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমার বদলি হয়েছে। কিন্তু নতুন একজন পিডি নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত তো আমার যাওয়ার সুযোগ নেই। আমি কখনও আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে কাজ করি না। আর পুলিশ দিয়ে হয়রানির কথা আপনার কাছেই শুনলাম। আমি মেডিকিটকেও চিনি না। ‘আনিফকো’কেও চিনি না। ফলে কারও প্রতি পক্ষপাতমূলক হওয়ার সুযোগ নেই।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারি কর্মচারী হাসপাতাল সম্প্রসারণ প্রকল্পের (৫০০ শয্যায় উন্নীতকরণ) চিকিৎসার যন্ত্র কেনার জন্য দুটি প্যাকেজে ৮৪ কোটি টাকার দরপত্র আহ্বান করা হয়। কিন্তু দরপত্রের নির্ধারিত শর্ত পূরণে ব্যর্থ হওয়ার পরও ক্রয় নীতিমালা লঙ্ঘন করে একটি নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক সিদ্দিকুর রহমান। আনিফকো নামে ওই প্রতিষ্ঠানকে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় এর আগেও তিন দফায় বাতিল করা হয়েছিল এই দরপত্র।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সরকারি কর্মচারী হাসপাতালের সম্প্রসারণ প্রকল্পের জিডি-১১ (এসকেএইচইউপি) ও জিডি-১২ (এসকেএইচইউপি) প্যাকেজের আওতায় ৮৪ কোটি টাকায় ৩৭৪টি গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতি কেনার জন্য গত জুলাইয়ে সর্বশেষ দরপত্র আহ্বান করা হয়। জিডি-১১ প্যাকেজে চারটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দরপত্র জমা দেয়। কিন্তু নির্ধারিত শর্ত পূরণ করতে না পারায় প্রাথমিক পর্যায়েই দুটি প্রতিষ্ঠান বাদ পড়ে যায়। দরপত্র পাওয়ার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আনিফকো হেলথকেয়ার ও মেডিকিট করপোরেশন।

 সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী বহনযোগ্য কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্র বা ভেন্টিলেটর সরবরাহের ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (ইউএসএফডিএ) অনুমোদন সনদ থাকতে হবে। কিন্তু আনিফকো হেলথকেয়ার ইউএসএফডিএ’র একটি ভুয়া সনদ জমা দেন। এছাড়া কার্ডিয়াক মনিটর কেনার জন্য দরপত্রে ‘এ’ গ্রুপের যন্ত্র নেওয়ার শর্ত ছিল। সাধারণত যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও জাপানের উৎপাদিত যন্ত্র ‘এ’ গ্রুপের হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু আনিফকো  চীনে উৎপাদিত ‘বি’ গ্রুপের যন্ত্র দেওয়ার কথা উল্লেখ করে। একইসঙ্গে দরপত্রে চারটি আল্ট্রাসাউন্ড ট্রান্সডুসার প্রোবসহ মেশিন কেনার কথা উল্লেখ ছিল। কিন্তু আনিফকোর প্রস্তাবিত দরপত্র শিট যাচাই করে দেখা গেছে এসব উল্লেখ করা হয়নি। অথচ প্রোব না থাকলে মেশিনটি পরিচালনা করা সম্ভবই হবে না।

দরপত্রের শর্ত ও জমাকৃত দরপত্র বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দরপত্রের শর্তে পাঁচ চাকাবিশিষ্ট আইসিইউ শয্যার কথা উল্লেখ থাকলেও আনিফকো চার চাকা বিশিষ্ট আইসিইউ শয্যা সরবরাহ করার কথা আবেদনে উল্লেখ করেছে। এরকম অনেক শর্ত পূরণে ব্যর্থ হলেও প্রকল্প পরিচালক আনিফকো হেলথকেয়ারকেই কাজ দেওয়ার সুপারিশ করেছেন। অথচ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা ২০১৮-এর ৫ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, আবেদনে গুরুত্বপূর্ণ অসঙ্গতি, অসাবধানতাজনিত ভুল বা বিচ্যুতি থাকলে প্রকল্পের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ব্যাখ্যা চাওয়ার সুযোগ রয়েছে। এছাড়া আবেদনে যন্ত্রের মানে কোনও বিচ্যুতি থাকলে কাজ পাওয়ার সুযোগ নেই।

সংশ্লিষ্টরা জানান, দরপত্রে কারসাজি, অনিয়ম ও দুর্নীতি করে প্রকল্প পরিচালক তার নিজের পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিচ্ছেন—এ বিষয়টি জানাজানি হলে প্রকল্প পরিচালক সিদ্দিকুর রহমানকে গত ১৫ অক্টোবর প্রকল্প থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হয়। সিদ্দিকুর রহমান তারপরও প্রকল্প পরিচালকের পদ ছাড়েননি। গত ২২ অক্টোবর সরকারি কর্মচারী হাসপাতালের কেনাকাটায় অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে দরপত্রে অংশ নেওয়া মেডিকিট করপোরেশন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব (ক্রয়কারী প্রধান) বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ দেন।

মেডিকিট করপোরেশনের স্বত্বাধিকারী শামীম আশরাফীকে দরপত্র নিয়ে দুর্নীতি হচ্ছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'দরপত্র প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। এই বিষয়ে কোনও কথা বলা যাবে না।'

তবে তিনি জানান, কিছু অজ্ঞাত ব্যক্তি মোবাইল ফোনে দরপত্রে অংশ নেওয়া নিয়ে ভয়ভীতিও দেখিয়েছে ও চাঁদা দাবি করেছে। এ বিষয়ে শাহবাগ থানায় জিডি করা আছে। গত শুক্রবার (২৫ অক্টোবর) হঠাৎ তার ধানমন্ডির বাসায় দুই দফায় পুলিশ গিয়ে খোঁজ-খবর করে। তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত কি না পুলিশ জানতে চায়। যদিও তিনি দীর্ঘদিন ধরে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।

শামীম আশরাফী জানান, হয়রানি ও চাঁদাবাজির বিষয়ে তিনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করা হয়েছে। তার বাসা ও অফিসের আশপাশে হুমকিদাতারা সার্বক্ষণিক অবস্থান করছেন। এতে তিনি মানসিক চাপে পড়েছেন। তার পরিবারের সদস্যরা ভয়ে বাসা থেকেও বের হতে পারছেন না।

রাহাত মালেকের সিন্ডিকেটেও ছিল আনিফকো

সংশ্লিষ্টরা জানান, বিগত সরকারের আমলে স্বাস্থ্যের কেনাকাটা একচ্ছত্রভাবে নিয়ন্ত্রণ করতেন সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের ছেলে রাহাত মালেক। সেই রাহাত মালেকের সিন্ডিকেটেও আনিফকো হেলথকেয়ারের সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আনিফকো হেলথকেয়ারের স্বত্বাধিকারী বাতেন শিকদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সব অভিযোগ মিথ্যা। আমি দরপত্রে অংশ নিয়েছি। সর্বনিম্ন দরের কারণে আমাদের আবেদন গৃহীত হয়েছে। এখন মূল্যায়ন চলছে। আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ করা হয়েছে— জাল সনদ বা অন্য কিছু, এসব ঠিক না। ২০ বছর ধরে মেডিক্যাল ইকুইপমেন্ট সেক্টরে সুনামের সঙ্গে আমরা কাজ করছি। আমাদের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে কাজ নেওয়া বা ঘুষ লেনদেন করার কোনও অভিযোগ নেই।’