কামরাঙ্গীরচর থানায় এখনও চলছে রদবদল

৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সারা দেশে পাঁচ শতাধিক থানা হামলার শিকার হয়। এদিন বাদ যায়নি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কামরাঙ্গীরচর থানাও। থানার বেশ কয়েকটি গাড়ি ও বিভিন্ন মালামাল ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। সেই ক্ষতি পুষিয়ে ওঠার চেষ্টা চলছে এখনও।

এদিকে সরকার পরিবর্তনের পর পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ে মতো বিভিন্ন থানায়ও রদবদল শুরু হয়। প্রায় দুই মাস কেটে গেলেও এখনও কামরাঙ্গীরচর থানায় রদবদল শেষ হয়নি। পুরনো পুলিশ সদস্যদের বদলির আদেশ হয়ে গেলেও থানায় আসেননি নতুন সব পুলিশ সদস্য। ফলে এখনও পুরোদমে চালু করা যাচ্ছে না থানার কার্যক্রম।

পুলিশ সদস্যরা বলছেন, বিগত সময়ে আওয়ামী লীগ সরকার পুলিশ বাহিনীকে দলীয়ভাবে ব্যবহার করায় ৫ আগস্ট থানা ও পুলিশের ওপর নজিরবিহীন হামলার ঘটনা ঘটেছে। যার ফলে নতুন সরকার আগের পুলিশ সদস্যদের সরিয়ে নতুনদের থানাগুলোয় পাঠাচ্ছে। সাধারণ মানুষের মধ্য থেকে পুলিশের প্রতি ক্ষোভ দূর করা এবং সেবা নিশ্চিত করাই এই রদবদলের উদ্দেশ্য।

কামরাঙ্গীরচর থানা সূত্রে জানা যায়, এ থানায় ওসি থেকে শুরু করে বেশিরভাগ পুলিশ সদস্য বদলি হয়ে গেছে। তবে ওসি, পরিদর্শক (তদন্ত), উপপরিদর্শক (এসআই) ও কনস্টেবলসহ ৩৮ জন নতুন পুলিশ সদস্য জয়েন করেছেন। পর্যায়ক্রমে অন্য পুলিশ সদস্যরা থানায় এসে যোগ দেবেন বলে জানান থানার নতুন ওসি আমিরুল ইসলাম।

হামলায় নষ্ট হয়ে যাওয়া কামরাঙ্গীরচর থানার নামফলক মেরামত করা হয়নি এখনও

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তিনটি ওয়ার্ড (৫৫, ৫৬ ও ৫৭) নিয়ে  কামরাঙ্গীরচর থানা গঠিত। প্রধানত সীমিত আয়ের লোকদের এই এলাকায় ছোট ছোট শিল্প কারখানা বেশি। মাদক, জুয়া, কিশোর গ্যাং, চুরি-ছিনতাই এবং পারিবারিক কলহের অভিযোগ বেশি আসে এ থানায়। গড়ে প্রতিদিন প্রায় ৫০টি অভিযোগ জমা পড়ছে কামরাঙ্গীরচর থানায়। পুলিশের অনুপস্থিতির সুযোগে এলাকায় অপরাধের প্রবণতা বাড়ছে বলে জানান কয়েকজন পুলিশ সদস্য ও স্থানীয় বাসিন্দারা।

উপপরিদর্শক (এসআই) মো. আলী জিন্নাহ বলেন, আমি নতুন জয়েন করেছি। তবে প্রতিদিনই নানা অভিযোগ নিয়ে থানায় আসছেন সাধারণ মানুষ। এর মধ্যে মোবাইল হারানোর জিডি ও পারিবারিক কলহ বেশি।

মুজিবুর রহমান নামে আরেক পুলিশ সদস্য বলেন, আমাদের বেশির ভাগেরই বদলির অর্ডার চলে এসেছে। আমরা এখন আর নতুন কাজ করতে চাচ্ছি না। কেননা, কোনও মামলা বা ঘটনার তদন্তে গেলে সেটা শেষ করা যাবে না। তাই কিছুটা স্থবিরতা আছে।

সরকার পতনের প্রায় এক সপ্তাহ পর ১১ আগস্ট থানার কার্যক্রম শুরু করে পুলিশ। বর্তমানে থানায় দুজন পরিদর্শক, ২০ জন উপপরিদর্শক (এসআই), ১৪ জন সহকারী উপপরিদর্শকসহ (এএসআই) এবং ২৯ জন কনস্টেবল রয়েছে। তবে এর মধ্যে নতুন জয়েন করেছেন ৩৮ জন পুলিশ সদস্য। বাকিদের বদলির অর্ডার হয়ে আছে। ৫ আগস্টের পর থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চাঁদাবাজি, মারামারি, দখলদারত্ব ও মাদক সংশ্লিষ্ট ১৬টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এসময়ে পারিবারিক দ্বন্দ্ব, সামাজিক অভিযোগ, হুমকি ও বিভিন্ন কিছু হারিয়ে যাওয়া অভিযোগে ২ হাজার ৫৩১টি সাধারণ ডায়রি (জিডি) জমা পড়েছে।

থানার ভেতরে ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটপাট চালায় হামলাকারীরা

কামরাঙ্গীরচর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আমিরুল ইসলাম বলেন, আগে এ থানায় ১৪০ জন পুলিশ সদস্য ছিল। বর্তমানে বেশিরভাগই বদলি হয়ে গেছে। পর্যায়ক্রমে নতুন পুলিশ সদস্য জয়েন করছেন। সবাই যোগ দিলে থানার কার্যক্রম পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে আসবে। তবে কোথাও কোনও সমস্যা হলে আমরা সঙ্গে সঙ্গে রেসপন্স করছি। পুলিশ সদস্যদের পাঠানো হচ্ছে। এ থানা এলাকার মানুষরা আমাদের সাদরে গ্রহণ করেছেন। বাসিন্দাদের সঙ্গে বর্তমানে পুলিশের বেশ ভালো সম্পর্ক স্থাপন হয়েছে। কোনও ঘটনা বা মব নিয়ন্ত্রণে আমাদের একটি গাড়ি পাঠালেই হচ্ছে।

ওসি আরও বলেন, পুলিশ জনগণের বন্ধু। শুধু কথায় নয়, আমরা সত্যিকার অর্থেই জনগণের বন্ধু হওয়ার চেষ্টা করছি। পুলিশের সঙ্গে জনগণের সুসম্পর্ক স্থাপনের বিভিন্ন কৌশল নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে। এছাড়াও জনসাধারণের মধ্যে পুলিশের প্রতি যে ক্ষোভ আছে তা দূর করার চেষ্টা চলছে। পুলিশ সদস্যদেরও মনোবল শক্ত ও সেবার মান বৃদ্ধিতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।

আমিরুল ইসলাম বলেন, আগে শহর ও গ্রামগুলোতে পঞ্চায়েত কমিটি ছিল। ছোটখাটো বিষয়গুলো সেখানে মিটমাট করা হতো। পুলিশ সদর দফতরের নিদের্শনা অনুযায়ী আমরা নাগরিক কমিটি গঠন করেছি, যাতে এলাকাভিত্তিক অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এ থানা এলাকার তিনটি ওয়ার্ডে তিনটি নাগরিক কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রতিটি কমিটিতে রাজনৈতিক ব্যক্তি, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি, ব্যবসায়ী, মসজিদ-মাদ্রাসার ইমাম-খতিব ও স্থানীয় সম্মানিত ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে মোট ১৫ জন সদস্য রয়েছে। এই নাগরিক কমিটিকে দেখভালে আবার ছয় সদস্যের একটি করে সমন্বয় কমিটি করা হয়েছে। আমরা আশা করছি দ্রুত অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। 

স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরছে কামরাঙ্গীরচর থানা

কী ঘটেছিল সেদিন?

৫ আগস্ট দুপুরে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও শেখ হাসিনা ভারতে চলে খবরে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসেন। দুপুর পৌনে ৩টার দিকে কিছু বিক্ষুব্ধ লোক কামরাঙ্গীরচর থানার সামনের রাস্তায় থাকা পুলিশের কয়েকটি গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। তারা পুলিশ সদস্যদের লক্ষ্য করে থানার ভেতরেও ইটপাটকেল ছুড়তে থাকে।

এসময় প্রায় আট ঘণ্টা থানায় অবরুদ্ধ ছিলেন পুলিশ সদস্যরা। পরে রাত সাড়ে ১২টার দিকে ফাঁকা গুলি ছুড়তে ছুড়তে থানা এলাকা ত্যাগ করে পুলিশ।

৫ আগস্ট থানায় আটকা পড়া কনস্টেবল মোক্তার হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সেদিন দুপুরে আমরা বিভিন্ন থানায় হামলা ও অগ্নিসংযোগের সংবাদ পাচ্ছিলাম। তবে আমাদের ধারণা ছিল, এ থানার পুলিশ সদস্যরা বিগত সময়ে কারও ওপর অন্যায়-অবিচার  করেনি, তাই হয়তো আমাদের ওপর হামলা করা হবে না। কিন্তু দুপুর ৩টার দিকে প্রথমে রাস্তায় পার্কিং করে রাখা থানার কয়েকটি গাড়িতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। পরে বিকালে সাড়ে ৫টার দিকে থানা কম্পাউন্ডের ভেতরে ঢুকে আরও কয়েকটি গাড়িতে আগুন ও ভাঙচুর করে তারা। এসময় কিছু ফাঁকা গুলি ছোড়া হলে তারা চলে যায়। তবে রাস্তা থেকে থেমে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকে।

থানার ভেতরে যে যেভাবে পেরেছে হামলা-লুটপাট-ভাঙচুর চালিয়েছে

তিনি আরও বলেন, এসময় আমরা বুঝতে পারছিলাম না কী করবো। তখনকার ওসি জুবায়ের স্যার ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে যোগাযোগ করছিলেন। তবে তেমন কোনও সাড়া পাওয়া যাচ্ছিল না। এরপর রাত সাড়ে ১১টার দিকে ডিসিশন হলো আমরা লালবাগ ডিসি অফিসের সামনে যাবো। তবে এর মধ্যে রাত ১১টার দিকে স্থানীয় কয়েকজন বিএনপি নেতাকর্মী আমাদের নিরাপদে থানা থেকে চলে যাওয়া আশ্বাস দেন। কিন্তু আমরা রাত সাড়ে ১২টার দিকে ফাঁকা গুলি করতে করতে ডিসি অফিসের দিকে চলে যাই। এরপর থানার ভেতরে ঢুকে লুটপাট করে দুর্বৃত্তরা। আমরা পরে জানতে পারি থানা ভবনের মালিক রাত ৩টার দিকে থানায় এসে স্থানীয়দের সরিয়ে তার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। কারণ থানা ভবনের মালিক স্থানীয়। যার কারণে পুরো থানায় আগুন দিতে পারে নাই।  

কামরাঙ্গীরচর থানা

ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ

পাঁচতলা ভাড়া ভবনে কামরাঙ্গীরচর থানার কার্যক্রম চলছে। ভবনের নিচতলা ও দোতলায় থানার কার্যক্রম চলে, অন্য ফ্লোরগুলোয় ব্যারাক হিসাবে থানার পুলিশ সদস্যরা থাকেন।

হামলার পর থানার বিভিন্ন কক্ষ থেকে মালামাল, অস্ত্র-গোলাবারুদ নিয়ে যায় নাশকতাকারীরা। ওসির কক্ষ, ডিউটি অফিসারের কক্ষ, পুলিশের থাকার জায়গা ও থানার স্টোররুমে ব্যাপক লুটপাট করা হয়। থানা থেকে ছয়টি অস্ত্র ও ৩২ রাউন্ড গুলি, বিভিন্ন অস্ত্রের ১২টি ম্যাগাজিন লুট করে দুর্বৃত্তরা। এছাড়াও সরকারি ছয়টি গাড়িতে আগুন, ৪০টি গাড়ি ভাঙচুর ও পুলিশের ব্যক্তিগত ১৫টি মোটরসাইকেল লুট করা হয়। এসময় থানা থেকে কম্পিউটার, মনিটর, প্রিন্টার, ফটোকপি মেশিন, পুলিশের বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট, হেলমেট, হাতকড়াসহ থানার বিভিন্ন সরঞ্জাম ও ব্যারাক থেকে বেশ কয়েকজন পুলিশের ব্যক্তিগত মালামাল লুট করা হয়েছে। সরকারি  ও ব্যক্তিগত নিয়ে অনন্ত তিন কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানান পুলিশ সদস্যরা।

ছবি: প্রতিবেদক