‘আগামীর বাংলাদেশ’ গড়ার কারিগর কন্যাশিশুরা কেমন আছে?

দেশের আইনে শাস্তিযোগ্য, অথচ বাল্যবিয়ের হার এখনও চমকে ওঠার মতো। আর এ ধরনের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগী মেয়েরা। শুধু বিয়েই নয়; চলাচলের স্বাধীনতা, কর্মক্ষেত্র, বেতন, সম্পদ ও পেনশন— এমন অনেকক্ষেত্রেই পিছিয়ে দেশের মেয়েরা। অথচ অধিকারকর্মীরা বলছেন, বাল্যবিয়ে, যৌনহয়রানি আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ঝরে পড়া কমানো ও দক্ষতা বাড়াতে পারলেই কেবল তারা দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখতে পারবে। যে কন্যাশিশুরা আগামীর বাংলাদেশ গড়বে, তারা কেমন আছে?

‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন’ অনুযায়ী, ১৮ বছরের নিচে কোনও মেয়ে এবং ২১ বছরের নিচে কোনও ছেলের বিয়ে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তবে এই আইনের ১৯ ধারায় ‘বিশেষ ক্ষেত্রে’, ‘অপ্রাপ্তবয়স্ক’ বা ১৮ বছরের কম বয়সী কোনও মেয়ের ‘সর্বোত্তম স্বার্থ’ বিবেচনায় আদালতের নির্দেশে বিয়ে হলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয় না। অথচ সবশেষ পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখনও ১৮ বছরের নিচে বাল্যবিয়ের হার ৫১ দশমিক ৪০। আর ১৫ বছরের নিচে এই হার ১৫ দশমিক ৫০। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও ইউনিসেফের সহযোগিতায় পরিচালিত জরিপ মাল্টিপল ইনডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভের ফলাফলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

আবার বিশ্বব্যাংকের ‘উইমেন, বিজনেস অ্যান্ড দ্য ল ২০২২’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুসারে, নারী-পুরুষ সমতার ক্ষেত্রে বিশ্বের ১৯০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৪। চলাচলের স্বাধীনতা, কর্মক্ষেত্র, বেতন, বিবাহ, অভিভাবকত্ব, উদ্যোক্তা, সম্পদ ও পেনশন—এই আটটি সূচকের ওপর এই স্কোর নির্ণয় করা হয়েছে। তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৪তম; স্কোর ১০০-এর মধ্যে অর্ধেকের কম, ৪৯ দশমিক ৪।

দেশের কন্যাশিশুদের অগ্রগতির এমন চিত্র হাতে রেখেই আজ সোমবার (৩০ সেপ্টেম্বর) উদযাপিত হচ্ছে ‘জাতীয় কন্যাশিশু দিবস’। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য করা হয়েছে, ‘কন্যাশিশুর স্বপ্নে গড়ি আগামীর বাংলাদেশ’। দিবসটি ঘিরে নানান কর্মসূচি হাতে নিয়েছে সরকারের বিভিন্ন দফতর ও সংস্থা। স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে দিবসটি উদযাপনে অধীনস্ত জেলা ও উপজেলা দফতরগুলোকে কর্মসূচি গ্রহণের নির্দেশনা দিয়েছে মহিলা বিষয়ক অধিদফতর। 

অন্যদিকে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোতে ২০১২ সাল থেকে প্রতিবছরের ১১ অক্টোবর পালিত হয় আন্তর্জাতিক কন্যা শিশু দিবস। এদিকে প্রতিবছরের ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে ৫ অক্টোবর পর্যন্ত আন্তর্জাতিক শিশু সপ্তাহ পালন করা হয়। এই শিশু সপ্তাহের দ্বিতীয় দিন, অর্থাৎ ৩০ সেপ্টেম্বর পালন করা হয় ‘জাতীয় কন্যা শিশু দিবস’।

এমন পরিস্থিতিতে অধিকারকর্মীরা বলছেন, শিশুরা আগামীর বাংলাদেশ গড়বে। তারা যেন বেড়ে ওঠে সমতার অধিকার নিয়ে, তার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে এই সমাজকে। বাল্যবিবাহ, যৌনহয়রানি আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ঝরে পড়া কমানো ও দক্ষতা বাড়াতে পারলেই কেবল তারা দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখতে পারবে।

কন্যাশিশু সুরক্ষা পেলে সব বৈষম্য দূর হবে উল্লেখ করে তারা বলছেন, অভিভাবকদের সবচেয়ে বেশি সোচ্চার হতে হবে কন্যা-শিশুদের অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে।

যে শিশুরা স্বপ্ন দেখাবে তারা কেমন আছে প্রশ্নে ইতিবাচক জবাব মিলছে কম। বিশ্বজুড়ে নারী ও কন্যা-শিশুদের প্রতি সহিংসতা ও নৃশংসতার ঘটনা বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪৫ শতাংশ শিশু, যাদের বয়স ১৮ বছরের কম। আর শিশুদের মধ্যে ৪৮ শতাংশ কন্যা-শিশু। মহিলা পরিষদের তথ্য প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নির্যাতনের শিকার ২২২ জন নারী ও কন্যা শিশুর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ২৬ জন কন্যাশিশুসহ ৪২ জন। তিন জন কন্যাশিশুসহ ১১ জন দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে, একজন কন্যাশিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। এছাড়াও ৫ জন কন্যাশিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে।

চলতি বছরের প্রথম ৮ মাসে (জানুয়ারি থেকে আগস্ট) ধর্ষণের শিকার হয়েছে ২২৪ কন্যাশিশু। একই সময়ের মধ্যে হত্যা করা হয়েছে ৮১ জনকে এবং আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে ১৩৩ জন কন্যাশিশু। ২৪ সেপ্টেম্বর জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে এই তথ্য জানায় জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম। ফোরামের সভাপতি ও নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, কন্যাশিশু যদি বঞ্চনার শিকার হয় তাহলে পুরো জাতিকে মাশুল দিতে হবে। আমাদের কন্যাশিশুরা বিদ্যা অর্জন থেকে বঞ্চিত। বাল্যবিবাহের সমস্যা নিরসন জরুরি।

‘আমরা কেন আমাদের শিশুদের নিরাপত্তা দিতে পারছি না’— প্রশ্ন ‍তুলে রবিবার ‘বিশ্ব শিশু দিবস ও শিশু অধিকার সপ্তাহ ২০২৪’ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সমাজকল্যাণ এবং মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ বলেন, ২০২৪ সালের এই শিশুরাই ছিল অগ্রভাগের সৈন্য। এই শিশুরাই এনে দিয়েছে নতুন এক বাংলাদেশ। তাদে এক নতুন নিরাপদ বাংলাদেশ উপহার দেওয়া, একটি সুন্দর নিরাপদ বাংলাদেশ উপহার দেওয়া আমাদের দায়িত্ব।

তিনি আরও বলেন, শিশুদের আনন্দ দিতে হবে। আনন্দের মধ্য দিয়ে নীতি-নৈতিকতা, আদর্শ, শিষ্টাচার ও পড়াশোনা শেখাতে হবে। পড়াশোনার পাশাপাশি সৃজনশীল  কাজ শেখাতে হবে। এতে তার চিন্তাশক্তি বৃদ্ধি পাবে।

কন্যাশিশুদের দক্ষ করে তোলার তাগিদ দিয়ে ‘উই ক্যান’ এর নির্বাহী সমন্বয়ক জিনাত আরা হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কন্যা শিশুকে বোঝা ভাবা যাবে না। রাষ্ট্র যেন তার কোনও কার্যক্রমে কন্যাশিশুর সঙ্গে বৈষম্য না করে। তাদের জন্য বিনিয়োগ করতে হবে। কন্যাশিশুদের দক্ষ করা হচ্ছে না। এখনও অনেকক্ষেত্রে সম্পত্তিতে সমানাধিকার দিলে শঙ্কা প্রকাশ করা হয়, সে সম্পত্তি রক্ষা করতে পারবে কিনা। অথচ তাকে দক্ষ না করে তার পাশে নিষেধাজ্ঞার বেড়াজাল দেওয়া হয়। স্বপ্নপূরণ করতে হলে তাকে সুযোগ দিতে হবে তা না, তাকে দক্ষ করতে হবে।