ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট রাজধানীর উত্তরা পূর্ব থানায় আগুন ধরিয়ে দেয় বিক্ষুব্ধ জনতা। এতে চারতলা থানা ভবনের দুটি ফ্লোর পুড়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। এমন অবস্থাতেই পোড়া ভবনে রঙ ও আংশিক মেরামত করে কার্যক্রম চালাচ্ছে থানা পুলিশ। তবে সংস্কারের পরও আগুনে পোড়া ভবন কতটা নিরাপদ—এমন শঙ্কা কাজ করছে পুলিশ ও সাধারণ মানুষের মাঝে।
৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর অন্যান্য থানার মতো উত্তরা পূর্ব থানায় হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। এর প্রায় এক সপ্তাহ পর ১৪ আগস্ট উত্তরা কমিউনিটি সেন্টারে অস্থায়ীভাবে থানার কার্যক্রম শুরু করে পুলিশ। একই দিন থেকে পোড়া ভবন সংস্কারের কাজও শুরু হয়। আংশিক মেরামত শেষে পহেলা সেপ্টেম্বর থেকে থানা ভবনে কার্যক্রম শুরু করে পুলিশ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গণঅভ্যুত্থানের সময়ে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় এখনও অনেক সদস্য ভয়, আতঙ্ক ও ট্রমার মধ্যে আছেন। অন্যদিকে বিগত সময়ে বিভিন্নভাবে হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার ছাত্র-জনতার ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে ৫ আগস্ট ও পরবর্তী সময়ে। পুলিশের এসব সমস্যা কাটিয়ে উঠতে আরও কয়েক মাস সময় লাগতে পারে। তবে সেটা নির্ভর করবে সাধারণ মানুষের সঙ্গে বর্তমান পুলিশ সদস্যদের সম্পর্ক ও পুলিশিং সেবার মানোন্নয়নের ওপর।
থানা সূত্রে জানা যায়, গত ১৪ আগস্ট থেকে ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছাত্র-জনতার ওপর হামলা ও হত্যার অভিযোগ, মারামারি ও মাদক সংশ্লিষ্ট মোট ২৯টি মামলা উত্তরা পূর্ব থানায় দায়ের করা হয়েছে। এ সময়ে পারিবারিক দ্বন্দ্ব, সামাজিক অভিযোগ, হুমকি ও বিভিন্ন কিছু হারিয়ে যাওয়ার অভিযোগে প্রায় আড়াই হাজার সাধারণ ডায়েরি (জিডি) জমা পড়েছে এই থানায়।
এ থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) কিবরিয়া মোবিন বলেন, আমরা চেষ্টা করছি জনগণের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন করার। বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের সঙ্গে মতবিনিময়ের মাধ্যমে পুলিশের প্রতি তাদের বিরূপ দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের চেষ্টা করা হচ্ছে। প্রকৃতভাবে পুলিশ জনগণের বন্ধু হয়ে ওঠার চেষ্টা করা হচ্ছে।
জানা যায়, থানায় হামলার সময় অনেক পুলিশ সদস্য প্রাণভয়ে ভবনের পেছন দিয়ে পালিয়ে যায়। এরপর এদিন রাত তিনটার দিকে সেনাবাহিনীর সদস্যরা থানা ভেতর থেকে ২৬ জন পুলিশ সদস্যকে জীবিত উদ্ধার করে। পরদিন সকালে থানার ছাদে পানির ট্যাংকিতে লুকিয়ে থাকা তিন জন পুলিশ সদস্য নেমে থানা থেকে বের হতে চাইলে একজন পুলিশ কনস্টেবল শহিদুলকে হত্যা করে বিক্ষুব্ধ জনতা।
থানা সূত্রে আরও জানা যায়, ৫ আগস্ট থানায় হামলার ঘটনায় বিভিন্ন ধরনের ৪৬টি অস্ত্র লুট হয়। এসময় চায়না, তরাশ, রাবার ও সীসা কার্তুজসহ অন্তত পাঁচ শতাধিক রাউন্ড গুলি এবং ম্যাগাজিন লুট হয়। এছাড়াও আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায় থানার ১০টি গাড়ি, ওয়্যারলেস সেট, সিসি ক্যামেরা, কম্পিউটার, সিলিং ফ্যানসহ বিভিন্ন মামলার নথিপত্র, আলামত এবং অন্যান্য ইকুইপমেন্ট ও মালামাল।
থানায় কর্মরত উপ-পরিদর্শক (এসআই) ওয়াদুদ ৫ আগস্টের ভয়াবহ বর্ণনা দিতে গিয়ে শিউরে ওঠেন। তিনি বলেন, সে সময়ের ভয়াবহ ঘটনা আর মনে করতে চাই না। ঘটনার দুই মাস পরও প্রতি রাতে আঁতকে উঠি। চোখের সামনে সহকর্মীদের নির্মম মৃত্যু দেখেছি। মনেপ্রাণে চাই বাংলাদেশে যাতে আরও কখনও এমন পরিস্থিতি তৈরি না হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন পুলিশ সদস্য জানান, পুলিশ সদস্যদের মধ্যে এখনও নানাভাবে ভয়ভীতি কাজ করছে। ৫ আগস্ট থানা থেকে প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুটপাট হয়েছে। যার বেশিরভাগই এখনও উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। ফলে যেকোনও সময় আবারও পুলিশের ওপর হামলার আতঙ্ক রয়েছে। এছাড়াও মাদক ও চুরি-ছিনতাই বেড়েছে কয়েকগুণ। অনেক জায়গায় অভিযান চালানোর সময় বাধার মুখোমুখি হতে হয়।
থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মহিবুল্লাহ বলেন, ‘৫ আগস্টে থানায় অগ্নিকাণ্ড, হামলা ও লুটপাটে অনেক লজিস্টিক সাপোর্ট এবং ইকুইপমেন্ট খোয়া গেছে। পর্যায়ক্রমে ক্ষতিগ্রস্ত স্থাপনা মেরামত করা হচ্ছে। প্রয়োজন অনুযায়ী পুলিশ সদর দফতর থেকে রিকুইজিশন দিয়ে বিভিন্ন ইকুইপমেন্ট আনা হচ্ছে। থানা এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে পুলিশের সম্পর্ক আগের মতোই আছে। কাজ করতে কোনও সময় হচ্ছে না।’
ওসি বলেন, ‘থানা ভবন রঙ করার আগে গণপূর্ত অধিদফতরের একটি টিম এসে পরিদর্শন করেছে। তারপর তারা ভবন রঙ ও সংস্কারের কাজ করেছে। ভবন সংস্কার কাজ এখনও চলমান রয়েছে। পুলিশ সদর দফতরের নির্দেশনায় সংস্কার কাজ চলছে। থানার প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের ইকুইপমেন্ট আনা হচ্ছে।