বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে সবচেয়ে রণক্ষেত্রে পরিণত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পার্শ্ববর্তী যাত্রাবাড়ী থানা এলাকা। আন্দোলন চলাকালে স্থানীয় ছাত্র-জনতার সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয় এই থানার পুলিশ ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের। এখানে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। যার রেশ পড়ে ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর। বিক্ষুব্ধ জনতা হামলা করে যাত্রাবাড়ী থানায়। ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগে পুরোপুরি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় থানাসহ তিনটি ভবন।
সরেজমিন দেখা গেছে, বর্তমানে থানা ভবনের সংস্কার কাজ চলছে। তবে ব্যবহার উপযোগী না হওয়ায় পার্শ্ববর্তী ডেমরা থানা থেকে সীমিত পরিসরে পরিচালিত হচ্ছে এই থানার কার্যক্রম।
যাত্রাবাড়ী থানার মূল ভবন দেখে বোঝার উপায় নেই যে কয়েক মাস আগেও এখানে ছিল ব্যাপক কর্মব্যস্ততা। প্রথম দেখায় মনে হবে কোনও ভুতুড়ে বাড়ি এটি। ছয়তলা ভবনজুড়েই ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন। থানার পাশাপাশি বাকি দুটি ভবনেরও একই চিত্র। বর্তমানে থানার মূল ভবন মেরামতের কাজ করছেন শ্রমিকরা। সরকার পতনের কয়েক দিন পরই থানা মেরামতের কাজ শুরু করা হয়। পুরোপুরি মেরামত করতে আরও দুই থেকে তিন মাস লাগতে পারে বলে জানান কর্মরত শ্রমিকরা।
শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, থানা ভবনের নিচ থেকে ওপর পর্যন্ত প্রতিটি কক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত। ছাদের পলেস্তারা থেকে স্যানিটারি ব্যবস্থা সবই নষ্ট হয়ে গেছে। তাদের ভাষ্যমতে, ভবনের মূল কাঠামো ছাড়া আর কিছুই ঠিক নেই। এক কথায় পুরো ভবনে নতুন করে সংস্কার করা লাগছে।
স্থানীয়রা জানান, শেখ হাসিনার পদত্যাগের খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে কয়েক হাজার বিক্ষুব্ধ জনতা যাত্রাবাড়ী থানা ঘেরাও করে। এসময় থানার ভেতর থেকে জনতাকে লক্ষ্য করে ব্যাপক গুলি চালানো হয়। এতে কয়েকশ’ মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়। তাদের মধ্যে অনেককে হাসপাতালে নেওয়ার পর মৃত ঘোষণা করা হয়। পরে ৫ আগস্ট বিকাল ৫টা নাগাদ পুলিশের একটি দল গুলি করতে করতে থানা থেকে বের হয়ে যায়। তবে কয়েকজন পুলিশ সদস্য ভেতরে আটকা পড়েন। বিক্ষুব্ধ জনতা তখন থানার ভেতরে ঢুকে যায়। ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। এ সময় জনরোষে পড়ে চার পুলিশ সদস্য মারা যান। সবশেষ থানা ভবনে অগ্নিসংযোগ করা হয়।
স্থানীয় বাসিন্দা রাহাত হাসান বলেন, আন্দোলন চলাকালে যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশের আচরণ ছিল মারমুখী। অনেকে তাদের গুলিতে মারা গেছে, অনেকে আহত হয়েছে। এছাড়া আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার সময় স্থানীয় সাধারণ মানুষের সঙ্গেও পুলিশের আচরণ ভালো ছিল না। অনেক পরিবার মানসিক, আর্থিক ও সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পুলিশের ভূমিকার কারণে। এর মধ্যে বিএনপি-জামায়াত পরিবার যেমন আছে, অনেক নির্দলীয় পরিবারের সদস্যরাও আছে। ওই দিন থানায় যা ঘটেছে, তা হয়তো ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ছিল।
যাত্রাবাড়ী থানার পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, থানা কমপ্লেক্সে হামলা, লুটপাট ও আগুনের ঘটনায় অন্তত ৪০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এই থানার ৭টি গাড়ি, তৎকালীন একজন এসি ও এডিসির গাড়িসহ মোট ৯টি গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। এছাড়া বাইরে থেকে আসা পুলিশ সদস্যদের গাড়িও সেদিন আগুনে পুড়ে যায়। থানার ভেতরে থাকা পুলিশ সদস্যদের মোটরসাইকেল, আলামত হিসেবে জব্দ করে আনা গাড়িও পুড়িয়ে দেওয়া হয়। লুটপাট করা হয় থানার আসবাবপত্র থেকে থানার ও পুলিশের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই থানার একজন পুলিশ সদস্য বলেন, যা ঘটেছে তার দায়ভার সিনিয়র কর্মকর্তাদের। আমাদের তো কিছু করার ছিল না। কিন্তু শেষমেশ জীবন গেলো চার জন সাধারণ পুলিশের। আমাদের জন্য এটা কষ্টের। পুলিশের সঙ্গে সাধারণ মানুষের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। আমরা মানসিকভাবে ভালো নেই। শুধু পরিবারের জন্য বাধ্য হয়ে চাকরি করছি।
থানা ভবনে কার্যক্রম পরিচালনার পরিবেশ না থাকায় বর্তমানে সীমিত পরিসরে পাশের ডেমরা থানা থেকে যাত্রাবাড়ী থানার কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। ৫ আগস্টের আগে যাত্রাবাড়ী থানায় জনবল ছিল ২৫৮ জন। তাদের মধ্যে পুলিশ সদস্য ছিলেন ২০৬ জন ও আনসার সদস্য ছিলেন ৫২ জন। এখন এই থানার পুলিশ সদস্যদেরও বদলি করা হচ্ছে। বর্তমানে ১৭৭ জন পুলিশ সদস্য রয়েছে এই থানায়। মাত্র তিনটি গাড়ি দেওয়া হয়েছে। তা দিয়েই থানা এলাকায় টহল, প্যাট্রোলিংসহ অন্যান্য কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। ডেমরা থানার তৃতীয় তলায় একটি কক্ষে যাত্রাবাড়ী থানার ডিউটি অফিসারের কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। সেখানে নিয়মিত জিডি ও অভিযোগ নিয়ে আসছেন মানুষ। প্রতিদিন গড়ে ২০০-২৫০টি অভিযোগ ও সাধারণ ডায়েরি বা জিডি জমা পড়ছে।
তবে ডেমরা থানায় কার্যক্রম পরিচালনা করায় যাত্রাবাড়ী এলাকার মানুষের ভোগান্তি হচ্ছে। আবদুল্লাহ নামে এক সেবাগ্রহীতা বলেন, ‘আমি কাজলা এলাকায় ব্যবসা করি। জিডি করতে যাত্রাবাড়ী থানায় গিয়েছিলাম। পরে ওখানে থাকা একজন ট্রাফিক পুলিশ ডেমরা থানায় আসতে বলেন। এখন কাজ বাদ রেখে এতদূর এসেছি।’
যাত্রাবাড়ী থানার সামনে টং দোকানি রাকিব বলেন, প্রতিদিন থানায় অনেক মানুষ আসে। আমার কাছে জিজ্ঞাসা করলে ডেমরা থানায় যেতে বলি। একটু পর পরই মানুষ এসে জিজ্ঞাসা করে থানা চালু হয়েছে কিনা।
তিনি আরও বলেন, যেহেতু গাড়ি কম, আমরা চাইলেও মোবাইল টিম বাড়াতে পারছি না। আবার কোথাও সমস্যার খবর পেলেও দ্রুত টিম পাঠানো যাচ্ছে না। আশা করছি দ্রুত সব সমস্যা সমাধান হবে।’
থানার পুলিশ সদস্যদের মানসিক অবস্থার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘অনেকেই বদলি হয়ে গেছেন। আবার অনেকে এখনও আছেন। সবার মধ্যেই একটা ট্রমা আছে। আমরা থানা এলাকার স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে কথা বলেছি। যেখানে যাচ্ছি ছাত্রদের সহযোগিতা নেওয়া হচ্ছে। আমাদের কাজে ছাত্ররা যথেষ্ট সহযোগিতা করছে। মানুষের আস্থাও বাড়ছে আমাদের ওপর।’