আওয়ামী লীগ সরকার পতনের খবর জানাজানি হওয়ার পরপরই ৫ আগস্ট বিকালে রাজধানীর আরও অনেক থানার মতো মিরপুর মডেল থানাও হামলার শিকার হয়। চার তলাবিশিষ্ট থানাটি পুরোপুরি জ্বালিয়ে দেয় হামলাকারীরা। আতঙ্কিত হয়ে থানা ছেড়ে পালিয়ে যান সেখানকার পুলিশ সদস্যরা। পরিস্থিতি শান্ত হলে দেখা যায়, পুড়ে ছাই হয়ে গেছে ভবন। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে পুরো থানা। টেবিল-চেয়ার-কাঠের দরজাও অবশিষ্ট নেই। লুট হয়েছে অস্ত্র ও মোটরসাইকেল। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে টহল গাড়ি।
বুধবার (১৮ সেপ্টেম্বর) মিরপুর মডেল থানা ঘুরে দেখা যায় থানা সংস্কারের কাজ চলছে। থানার পেছনে একটি টিনশেডে ওসির অস্থায়ী অফিস করা হয়েছে। পুলিশ সদস্যদের থাকার জন্য ব্যবহৃত অন্য একটি ভবনের নিচতলার সিঁড়ির পাশে ছোট একটি রুমে থানার অভিযোগ নেওয়ার কার্যক্রম চলছে। এছাড়া টহল কার্যক্রম চলমান রাখতে অন্য থানা থেকে চারটি গাড়ি এনে ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে এই গাড়িগুলোর অবস্থা তেমন ভালো নয় বলে জানান পুলিশ সদস্যরা। বৃষ্টিতে গাড়ির ভেতরে পানি আসে বলে অভিযোগ তাদের।
থানার পুলিশ সদস্যরা জানান, ৫ আগস্ট বিকালে থানায় হামলা চালায় বিক্ষুব্ধ কিছু মানুষ। তাদের সঙ্গে উৎসুক জনতাও যুক্ত হয়। সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত থানায় হামলা ঠেকানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু ততক্ষণে থানায় ঢুকে পড়ে জনতা। এসময় প্রাণ বাঁচাতে থানার পেছন দিয়ে পালিয়ে যেতে হয় পুলিশ সদস্যদের। এই ঘটনায় কোনও পুলিশ সদস্য নিহত না হলেও চার জনের মতো আহত হন।
দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে ৭ আগস্ট থানায় আসতে শুরু করেন পুলিশ সদস্যরা। ৯ তারিখের মধ্যে বাকি পুলিশ সদস্যরা কাজে আসেন। কাজে ফিরে ধ্বংসস্তূপ দেখে বিস্মিত হয়ে যান তারা। তবু কাজ করে যেতে হবে বলে কোনোমতে কাজ শুরু করেন। প্রথম দিকে থানার সামনের বাগানে থাকা ছাউনিতে বসে অভিযোগ নেওয়ার কাজ শুরু করেন।
তথ্যমতে মিরপুর মডেল থানায় পুলিশ ও আনসার মিলিয়ে প্রায় দুই শতাধিক সদস্য ছিলেন। এর মধ্যে সাধারণ পুলিশ সদস্য ছিলেন প্রায় ১৬০ জন। তাদের কেউ কেউ ইতোমধ্যে বদলি হয়ে অন্য থানায় চলে গেছেন। যারা এই থানায় ৫ আগস্ট ছিলেন, তাদের অনেকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন বা আছেন এখনও।
কথা হয় মডেল থানার সাবেক ওসি মো. মনিরুল ইসলামের সঙ্গে। যদিও তিনি ৫ আগস্টের পর এই থানায় যুক্ত হয়ে আবার ১৮ সেপ্টেম্বর বদলি হয়েছেন। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, থানার সব পুলিশ সদস্যই কাজে ফিরেছেন। এর মাঝে কেউ কেউ বদলি হয়েছেন।
ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে তিনি বলেন, ভবন তো পুরোটাই পুড়ে গেছে। ওসির গাড়ি ভাঙচুর হয়েছে, যা পরবর্তীতে মেরামত করা গেছে। টহলের ৭টি গাড়ি ছিল, সেগুলো পুরোপুরি পুড়ে গিয়েছে। এছাড়া রায়ট কার রাখা ছিল, সেটিও পুড়ে গেছে। বর্তমানে বিভিন্ন থানা থেকে চারটি গাড়ি নিয়ে কার্যক্রম চলছে।
এছাড়া এসআই, এএসআই ও সাব-ইন্সপেক্টরদের ব্যক্তিগত কিছু বাইকসহ আলামতের অনেক বাইক থানা থেকে লুট হয়ে গেছে বলেও জানান ওসি।
অস্ত্র লুট হয়েছে কিন্তু সংখ্যাটা এখনও নির্ণয় করা হয়নি জানিয়ে ওসি মনিরুল বলেন, পুলিশের অস্ত্র লুট হয়েছে বেশি। আর ব্যক্তিগত যেসব অস্ত্র জমা ছিল থানায়, সেগুলো আগুনে পুড়ে গেছে। কিছু অস্ত্র উদ্ধার করা হচ্ছে।
বর্তমানে কী ধরনের কার্যক্রম চলছে জানতে চাইলে থানার ডিউটি অফিসার আজিজুল হক স্বপন বলেন, এখানে যখন কার্যক্রম শুরু হয় তারপর থেকে বেশিরভাগ বিভিন্ন কাগজপত্র হারানো, মোবাইল চুরির অভিযোগ এসেছে। এর বাইরে এখনও জটিল কোনও অভিযোগ দায়ের করতে আসেনি কেউ। রিসেন্ট কিছু কিছু মারধর ও অন্যান্য অভিযোগও আসা শুরু করেছে।
কর্মস্থলে ফিরলেও মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন বলে জানান মিরপুর মডেল থানার বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য। তারা বলেন, ৫ আগস্টের চিত্র ছিল ভয়াবহ। চোখের সামনে নিজেদের থানা আগুনে পুড়তে দেখেছি। প্রাণ রক্ষার্থে পালিয়ে বাঁচতে হয়েছে। এরকম পরিস্থিতির কথা কেউ চিন্তাও করে নাই। তাই কাজে ফিরেও অনেকদিন মনের ভেতর থেকে আতঙ্ক কাটেনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ সদস্য বলেন, এটা পুলিশের জন্যও লজ্জার। আমি যাকে সেবা দেবো সে যখন আমাকে আঘাত করে তখন কেমন লাগে?
আরেক পুলিশ সদস্য বলেন, এক সপ্তাহের ওপরে ঘুমাতে পারিনি। পুলিশকে মেরে ঝুলিয়ে রাখা, গাড়ির মধ্যে র্যাব সদস্যকে খুঁচিয়ে মারা, এগুলো আমাদের খুব দুর্বল করে দিয়েছে।