বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের জেরে যে নাটকীয় পালাবদল ঘটেছে, পাকিস্তানেও তা অভূতপূর্ব সাড়া ফেলেছে। এই পটভূমিতে পাকিস্তানে স্কুল-কলেজের পাঠ্যপুস্তকে একাত্তরের যুদ্ধ ও বাংলাদেশের জন্ম নিয়ে কী পড়ানো হয়, তা নিয়েও আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশে। তাদের ইতিহাস বইতে পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হওয়ার জন্য যেসব কারণকে দায়ী করা হয়, বাংলা ট্রিবিউনের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বিশদ আলোকপাত করা হয়েছে সেসব বিষয়ে।
একাত্তরে বাংলাদেশ-পাকিস্তান যুদ্ধে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পক্ষ ছিল ভারত। তবে ভারতের স্কুল-কলেজে এই যুদ্ধ প্রসঙ্গে পাঠ্যপুস্তকগুলো ঠিক কী বলছে এবং ছাত্র-ছাত্রীদের ঠিক কী শেখানো হচ্ছে, সেটি নিয়েও রয়েছে সমান আগ্রহ। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের স্কুল-কলেজ পর্যায়ে এই যুদ্ধ নিয়ে কিছুই পড়ানো হয় না। আবার কিছু রাজ্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থাকলেও তাকে ‘ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়।
ভারতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তাদের যে জাতীয় পাঠ্যক্রম নীতি রয়েছে, সেটা সর্বভারতীয় স্তরে তৈরি করা হয়, যার নিয়ন্ত্রণ দিল্লির হাতে। প্রতিটি রাজ্যে শুধু সেটা স্থানীয় ভাষায় তর্জমা হয়। ওই পাঠ্যক্রম যারা তৈরি করেছেন, তাদের নিশ্চয়ই মনে হয়েছে যে বাংলাদেশ সৃষ্টির ইতিহাস ছাত্র-ছাত্রীদের জানার দরকার নেই। তবে ভারতের স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের এই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়ানো উচিত ছিল বলে মনে করেন তারা।
ভারতে স্কুলপর্যায়ের পাঠ্যপুস্তকের সবচেয়ে বড় প্রণেতা সংস্থা হলো এনসিইআরটি (ন্যাশনাল কাউন্সিল অব এডুকেশনাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং)। ভারতের কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে এই সংস্থাটির রচিত বই সারা দেশের সবচেয়ে বেশি স্কুলে পড়ানো হয়ে থাকে– যার মধ্যে সিবিএসই, আইসিএসইসহ বিভিন্ন রাজ্যের শিক্ষা বোর্ড রয়েছে। এক কথায় বলতে গেলে, এনসিইআরটি হলো ভারতের প্রধানতম স্বীকৃত স্কুলপাঠ্য প্রকাশনা সংস্থা।
এনসিইআরটির ‘সমকালীন বিশ্ব রাজনীতি’ শীর্ষক পাঠ্যপুস্তকের তৃতীয় চ্যাপ্টারে দক্ষিণ এশিয়া প্রসঙ্গ নিয়ে বিশদ আলোচনা হয়েছে। সেখানেই এসেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের বিষয়টি। ওই বইয়ের ৩৩ ও ৩৪ পৃষ্ঠায় এ বিষয়টি আলোচিত হয়েছে, সেখান থেকে হুবুহু তুলে দেওয়া হলো—
‘বাংলাদেশ ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল অবধি পাকিস্তানের অংশ ছিল। দেশভাগের সময় ব্রিটিশ ভারতের বাংলা ও আসামের যে অংশটি পাকিস্তানের মধ্যে পড়ে, সেটিই পরে স্বাধীন বাংলাদেশে পরিণত হয়। এই অঞ্চলের মানুষ পশ্চিম পাকিস্তানের আধিপত্যবাদ ও উর্দু ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে গর্জে উঠেছিলেন। বাংলার সংস্কৃতি ও ভাষার বিরুদ্ধে পাকিস্তানে যে অন্যায় ও বৈষম্যমূলক আচরণ করা হতো, দেশভাগের কিছুকাল পর থেকেই বাঙালিরা তার প্রতিবাদ শুরু করেন।
‘তারা দেশের প্রশাসনে ও রাজনৈতিক ক্ষমতাতে নিজেদের ন্যায্য প্রতিনিধিত্বর জন্য দাবি জানাতে থাকেন। পশ্চিম পাকিস্তানের এই প্রভুত্বের বিরুদ্ধে জন-আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন শেখ মুজিবুর রহমান। দেশের পূর্বাঞ্চলের জন্য তিনি স্বশাসন দাবি করেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের সব আসনে জেতে। এর মাধ্যমে গোটা পাকিস্তানের প্রস্তাবিত গণপরিষদেও (কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি) তারা গরিষ্ঠতা অর্জন করে।
‘কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানিদের কর্তৃত্বপূর্ণ সামরিক সরকারের নেতৃত্ব গণপরিষদ গঠন করতে অস্বীকার করে। শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নেতৃত্বাধীন সেনা সরকার বাঙালিদের গণ-আন্দোলনকে দমন করতে কঠোর নিপীড়ন শুরু করে। পাকিস্তানি সেনার হাতে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। এর ফলে বিপুলসংখ্যক মানুষ ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এই ‘মাইগ্রেশন’ (অভিবাসন) ভারতের জন্য একটি বিশাল শরণার্থী সংকট সৃষ্টি করে।
‘এই পটভূমিতে ভারত সরকার পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের স্বাধীনতার দাবিকে সমর্থন করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং তাদের অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে সাহায্য করতে থাকে। এর পরিণতিতেই ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি ফৌজের আত্মসমর্পণ ও স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের মধ্য দিয়ে সেই যুদ্ধের অবসান ঘটে।’
ঠিক এর আগের অধ্যায়ে পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক চেতনার বিকাশের অভাব নিয়েও বিশদ আলোচনা করা হয়েছে, যা পৃথক বাংলাদেশ গঠনের পথ প্রশস্ত করেছিল বলেও আভাস দেওয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, এনসিইআরটি এই বইটা তৈরি করে মূলত নবম বা দশম শ্রেণির জন্য। তবে বিভিন্ন বোর্ড তাদের সুবিধামতো কেউ নবম শ্রেণিকে, কেউবা দশম শ্রেণিতে পড়ায়।
দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষক শুভ্রাংশু সেনগুপ্ত বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি মনে করি এনসিইআরটির টেক্সট বুকে বাংলাদেশ সৃষ্টির পরিপ্রেক্ষিত মোটামুটি সঠিকভাবেই বর্ণনা করা হয়েছে। তবে এখানে প্রধান সীমাবদ্ধতার জায়গাটা হলো, একাত্তরের যুদ্ধকে প্রধানত ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হিসেবেই তুলে ধরা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই বলি বা স্পিরিট, তার অবদান...এগুলোকে কোনও স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি।’
এই মূল্যায়নের সঙ্গে অনেকটাই একমত লেখক, চিত্রনির্মাতা, সাংবাদিক ও সাবেক পার্লামেন্টারিয়ান প্রীতিশ নন্দী।
মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য ‘ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশ’ সম্মাননা পাওয়া প্রীতিশ নন্দী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পাকিস্তান যেভাবে একাত্তরের অপমানকে তাদের দেশের ছাত্রদের কাছে তুলে ধরেছে, সেটার কারণ সহজবোধ্য। কিন্তু আমি বুঝতে পারি না ভারতের জন্য বাংলাদেশের জাতিসত্তা, তাদের স্বাধীনতার লড়াইকে তুলে ধরতে অসুবিধা কোথায়?’
ভারতে ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তকে এই বিষয়টার যে উল্লেখ থাকে না, সেটা মনে করিয়ে দিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘আসলে আমাদের তথাকথিত শত্রু দেশ পাকিস্তানের সঙ্গে এই যুদ্ধ যুদ্ধ ন্যারেটিভ আমাদের এমনভাবে শেখানো হয়েছে যে সেখানে অন্য একটি জাতির লড়াইকে সম্মান জানানোর মতো উদারতা তৈরিই হয়নি! গড়পড়তা ভারতীয় ছাত্ররা জানতেও পারেনি বাংলাদেশ সৃষ্টির পেছনে একটা ভাষার আন্দোলন ছিল, একটি জাতির বঞ্চনার বিরুদ্ধে গর্জে ওঠার উজ্জ্বল ইতিহাসও ছিল।’
অনেকটা একই কারণে বলিউডে একাত্তর নিয়ে তেমন কোনও ভালো ছবি তৈরি হয়নি বলেও অভিমত প্রীতিশ নন্দীর। তিনি বলছিলেন, ‘খেয়াল করে দেখবেন একাত্তর নিয়ে সামান্য যে কয়েকটা ছবি তৈরি হয়েছে, সেটাও মূলত ভারতের ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার-কেন্দ্রিক (মানে ভারতের পশ্চিম সীমান্তের), পূর্ব রণাঙ্গনে বা বাংলাদেশে কী ঘটেছিল সেদিকে বলিউড নজরই দিতে পারেনি।’
বছর কয়েক আগে বিবিসির এক প্রতিবেদনে কলকাতার একটি স্কুলের তখনকার দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী রূপকথা চক্রবর্তীকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছিল, ‘এটা আমাদের বইতে দ্বিতীয় ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ হিসেবে রয়েছে। বেশ বিশদভাবে রয়েছে, যেমন যুদ্ধের আগের ঘটনাক্রম, যুদ্ধ কবে থেকে শুরু হলো, কবে শেষ হলো, যুদ্ধের নেতৃত্ব কারা দিয়েছিলেন—সবই আছে বইয়ে।’
কিন্তু বইয়ের বাইরে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আরও কিছু জানার আগ্রহ যখন তৈরি হয় এই ছাত্রীর, তার জন্য ভরসা বাবা-মা। ‘তাদের কাছ থেকেই জেনেছি কিছু কিছু, যেগুলো বইতে নেই’, বিবিসিকে বলেছিলেন রূপকথা চক্রবর্তী।
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারি বোর্ডের দ্বাদশ শ্রেণির সিলেবাসেও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়ানো হয় বিস্তারিতভাবেই। রূপকথা চক্রবর্তী যে বোর্ডের অধীনে পড়েছেন, সেই আইসিএসই একটি জাতীয় শিক্ষা বোর্ড, তবে তা বেসরকারি পরিচালনাধীন।
ত্রিপুরার স্কুল পাঠ্যক্রমে আবার মুক্তিযুদ্ধের ওই ইতিহাসও পড়ানো হয় না, কারণ সেখানকার রাজ্য শিক্ষা বোর্ড অনুসরণ করে জাতীয় স্তরের সরকারি বোর্ডের পাঠ্যক্রম।
অথচ কলকাতার মতোই ত্রিপুরার আগরতলাও মুক্তিযুদ্ধে অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। তবু সেখানকার স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা জানতেই পারে না সেই মুক্তিযুদ্ধের কথা।
ত্রিপুরার গান্ধীগ্রাম উচ্চমাধ্যমিক স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত ইতিহাসের শিক্ষক বীরেন্দ্র ভট্টাচার্য বলেন, ‘আমাদের যে জাতীয় পাঠ্যক্রম নীতি রয়েছে, সেটা সর্বভারতীয় স্তরে তৈরি করা হয়। তার নিয়ন্ত্রণ দিল্লির হাতে। প্রতিটা রাজ্যে শুধু সেটা স্থানীয় ভাষায় তর্জমা করা হয়। ওই পাঠ্যক্রম যারা তৈরি করেছেন, তাদের নিশ্চয়ই মনে হয়েছে যে বাংলাদেশ তৈরি হওয়ার ইতিহাসটা ছাত্র-ছাত্রীদের জানার দরকার নেই। তাই তারা রাখেননি বিষয়টা। তবে স্নাতক আর স্নাতকোত্তর স্তরে ইতিহাসের পাঠ্যক্রমে পড়ানো হয় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস।’
তার আক্ষেপ, স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদেরও এই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়ানো উচিত ছিল।
ত্রিপুরা লাগোয়া আসামে আবার ইতিহাসের বদলে একাদশ-দ্বাদশ ক্লাসের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পাঠ্যক্রমে পড়ানো হয় ওই যুদ্ধের কথা। আর বাঙালি এলাকা বরাক উপত্যকার আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক স্তরেও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত একাত্তরের ইতিহাস।
‘আসাম বোর্ডের একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির যে ইতিহাসের পাঠ্যক্রম, সেখানে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বলে কিছু নেই। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পাঠ্যক্রমে রয়েছে বিষয়টা। তবে সেটাকে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বলেই নামকরণ করা হয়েছে’, বলছিলেন শিলচরের রাধা মাধব কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপক সুদর্শন গুপ্ত।
তবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের ইতিহাস স্নাতক স্তরের পাঠ্যক্রমে বেশ কয়েক বছর আগেই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়টির অধীনে উত্তরপাড়া প্যারিমোহন কলেজে ইতিহাসের বিভাগীয় প্রধান শর্মিষ্ঠা নাথ বলেন, ‘আমরা যখন ছাত্রী হিসেবে ইতিহাস পড়েছি, তখন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়ানো হতো না। কিন্তু ৮ থেকে ১০ বছর আগে থেকে স্নাতক স্তরের সিলেবাসে এটা অন্তর্ভুক্ত হয়। আর খুব বিশদভাবেই পড়াই আমরা এটা।’
‘এখানে মুক্তিযুদ্ধটাকে শুধু আলাদা একটা ঘটনা বলে দেখাই না আমরা। দেশভাগের পর থেকেই পশ্চিম পাকিস্তান যেভাবে পূর্ব অংশকে অর্থনৈতিকভাবে শোষণ করেছে, সেখানকার সংস্কৃতির ওপরে আধিপত্য বিস্তার করতে চেয়েছে, যার ফলে ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন—সবই পড়াই আমরা। বায়ান্ন থেকে যার শুরু, তারই তো অন্তিম পর্যায় ’৭১—এই গোটা সময়ের ইতিহাসটাই আমরা ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াই,’ বলছেন শর্মিষ্ঠা নাথ।
ভারতের অনেক শিক্ষক বা অধ্যাপক আবার বলছেন, সম্প্রতি স্নাতকোত্তর স্তরে বা গবেষণা ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেকেই কাজ করতে আগ্রহী হচ্ছেন। সেগুলো শুধু মুক্তিযুদ্ধের সামরিক ইতিহাসে সীমাবদ্ধ থাকছে না; যুদ্ধের নানা সামাজিক দিক নিয়েও চর্চা করছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞান, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বা ইতিহাসের গবেষকরা।
আরও পড়ুন: