সংকট-সীমাবদ্ধতার মাঝে যেভাবে চলছে মোহাম্মদপুর থানা

কোটা সংস্কার ও ছাত্র-জনতার সরকার পতনের আন্দোলন চলার সময় সৃষ্ট সহিংসতায় সারা দেশে প্রায় ৮০০ মানুষ নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন শত শত। আন্দোলন দমাতে সরকারের বিভিন্ন বাহিনী দায়িত্ব পালন করলেও ছাত্র-জনতার আহত ও নিহতের ঘটনায় বেশি অভিযোগ ওঠে পুলিশের বিরুদ্ধে। ফলে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর পাল্টা আক্রমণের শিকার হয় পুলিশ বাহিনী। পুলিশ সদর দফতর, বিভিন্ন ইউনিট ও থানায় হামলা-লুটপাট চালানো হয়। অগ্নিসংযোগ করা হয় প্রায় ৫০০ থানায়। এতে পুলিশ অনেক সদস্য নিহত ও আহত হন।     

ক্ষুব্ধ জনতার হামলা থেকে রেহাই পায়নি ঢাকা নগরীর মোহাম্মদপুর থানাও। ৫ আগস্ট সন্ধ্যায় এই থানায় হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। ফলে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় মোহাম্মদপুর থানা। 

চারতলা থানা ভবনের প্রতিটি কক্ষে লুটপাট চলে। বিভিন্ন ধরনের অন্তত ২০টি গাড়ি ভাঙচুর ও কয়েক ডজন মোটরসাইকেলে অগ্নিসংযোগ করা হয়। এর মধ্যে অনেক মোটরসাইকেল বিভিন্ন মামলার জব্দ করা আলামত হিসেবে ছিল। থানা ভবনে দেওয়া আগুনে ওসি, পরিদর্শক, ডিউটি অফিসারের কক্ষগুলো পুড়ে যায়। ধ্বংস হয় সব ধরনের আসবাবপত্রও। লুট করা হয় অস্ত্রাগারও। পুড়ে যাওয়া থানা ভবনটিতে কিছুই অবশিষ্ট নেই।  

মোহাম্মদপুর থানার পুড়ে যাওয়া গাড়িক্ষতিগ্রস্ত থানাটির দৈনন্দিন কাজকর্ম কীভাবে চলছে তা জানতে সোমবার (৮ সেপ্টেম্বর) সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়— পুরো ভবনটি ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করা হয়েছে। নানান সীমাবদ্ধতার মধ্যেই চলছে থানার কার্যক্রম। ডিউটি অফিসারের কক্ষটি নতুনভাবে সংস্কার করা হলেও এখনও পুরোপুরি ব্যবহারের উপযোগী হয়ে ওঠেনি। থানার ভেতর অবস্থিত নারী ও শিশু সাপোর্ট সেন্টারেরও একই অবস্থা। একটি কাঠের টেবিল আর কয়েকটি চেয়ারের ব্যবস্থা করা হয়ে। সেখানে একজন এএসআই একাই কাজ করছেন। ভবনটির নিচতলায় প্রবেশমুখের সামনেই থানার অফিসার ইনচার্জের (ওসি) কক্ষ। সেখানে লোকজনের ভিড় দেখা গেলো। থানায় আসা সেবাপ্রার্থীদের বিভিন্ন অভিযোগ শুনছিলেন ওসি। এছাড়া থানার অন্য কক্ষগুলোর অবস্থা এখনও এলোমেলো। এর মাঝেই পুলিশ কর্মকর্তারা কাজ চালিয়ে নিচ্ছেন।

জানা গেছে, মোহাম্মদপুর থানায় বর্তমানে পুলিশের ৩ জন পরিদর্শক, ৩৮ জন এসআই, ৪২ জন এএসআই (ফাঁড়িসহ), ৪২ জন কনস্টেবল এবং ৩১ জন আনসার সদস্য কর্মরত আছেন। তাদের মধ্যে তিন-চার জন ছাড়া বাকি সবাই দায়িত্ব পালন করছেন। ৮টি টহল গাড়ির মধ্যে বর্তমানে ৬টি সচল রয়েছে। থানার আওতাধীন এলাকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষার নিয়মিত টহলে  এসব গাড়ি ব্যবহার করা হচ্ছে।

হামলার পর থানা ভবনের ভেতরের চিত্রথানার একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, লুটপাট ও আগুনের পর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। পুলিশ সদর দফতর ও বিভিন্ন থানা থেকে কিছু সরঞ্জাম ধার-দেনা করে কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। নতুন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) থানায় যোগদান করার পর ধীরে ধীরে সবকিছু স্বাভাবিক করার চেষ্টা হচ্ছে।

এ থানায় সদ্য যোগদান করা ডিউটি অফিসার উপপরিদর্শক (এসআই) রব্বানী জানান, আমি একদিন আগে বদলি হয়ে এসেছি। আজই প্রথম অফিস করছি। এত লোকজন থানায় আসছেন সেবা নিতে, এক মিনিটও বসে থাকার সুযোগ নেই। বিভিন্ন বিষয়ে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) জমা পড়ছে বেশি। আমরাও চেষ্টা করছি সবাইকে সাধ্যমতো সেবা দেওয়ার।

অপর পাশে একটি কক্ষে নারী ও শিশু সাপোর্ট সেন্টারে কাজ করছিলেন এএসআই হাসিনা। তিনি বলেন, ‘ঘটনার প্রায় এক সপ্তাহ পর আমরা থানায় বসে কাজ শুরু করি। এরপর থেকে স্বাভাবিকভাবেই কাজ করার চেষ্টা করছি। কিছু দিন থানার কাজ বন্ধ থাকায় অনেক অভিযোগ জমে গিয়েছিল। সেগুলো এখন একসঙ্গে আসছে, তাই কাজের চাপ বেশি।’

মোহাম্মদপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আলী ইফতেখার হাসান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি যোগদানের পর থানার নিয়মিত টহলগুলো জোরদার করার চেষ্টা করেছি। ফোর্সদের সঙ্গে নিজেও রাতে টহলে যাচ্ছি। আমাদের বেশিরভাগ গাড়িতেই আগুন দেওয়া হয়েছিল। গাড়িগুলোর কিছু মেরামত করা হয়েছে, আরও কিছু প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা এখনও আগের অবস্থানে যেতে পারিনি। সীমিত সাধ্য নিয়ে বর্তমানে কাজ করে যাচ্ছি। এতে কিছু চ্যালেঞ্জ আছে। যেহেতু গাড়ির সংখ্যা কম, সেহেতু কাঙ্ক্ষিত সেবা দেওয়া যাচ্ছে না। থানার কিছু লোক ঘটনার সময় আহত হয়েছিলেন। তারা এখনও হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। বাকিরা সবাই বর্তমানে অফিস করছেন।’

পুড়ে যাওয়া থানা ভবনের বর্তমান অবস্থাওসি আরও বলেন, ‘এই থানায় আগে সরকারি গাড়ি ছিল ৮টি। এখন আছে ৬টি। এগুলো মেরামত করে কোনোভাবে চলার উপযোগী করা হয়েছে। ইউনিফর্মও লুট হয়েছিল। সেগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে। থানা থেকে লুট হওয়া কিছু অস্ত্র পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার হয়েছে। অস্ত্র ছাড়াই আমরা ডিউটি করছি। অস্ত্র নিয়ে ডিউটিতে যাওয়ার বিষয়ে এখনও কোনও নির্দেশনা পাইনি।’

ওসি বলেন, ‘এই থানা থেকে কতগুলো অস্ত্র লুট হয়েছে—তা এখনই ডিসক্লোজ করছি না, যেহেতু এ বিষয়ে কোনও মামলা হয়নি। তবে মামলা প্রক্রিয়াধীন আছে। ছাত্র হত্যার মামলা ও ছিনতাই—এসব নিয়ে মামলা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবে যেসব মামলা হতো, জিডি হতো, এসবই হচ্ছে। এখনও আমাদের নানান সংকট রয়েছে, সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তার মধ্যেই আমরা থানার সব কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।’