ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনসহ ১৫ দফা দাবি জানিয়েছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘লড়াকু ২৪’। সোমবার (১৬ সেপ্টেম্বর) জাতীয় প্রেসক্লাবের মাওলানা আকরম খাঁ হলে সংবাদ সম্মেলনে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে এ দাবি জানায় সংগঠনটি।
সংবাদ সম্মেলনে লড়াকু ২৪-এর সদস্য কানিজ ফাতেমা মিথিলা বলেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আহতদের অনেকে এখনও বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন, হাত-পা হারিয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন অনেকে। আবার অনেকের মাথায় বা মেরুদণ্ডে গুলিবিদ্ধ হওয়ার কারণে প্যারালাইজড হয়েছেন। আন্দোলনে আহত-নিহতদের একটা অন্যতম অংশ শ্রমজীবী, খেটে-খাওয়া মানুষ। তাদের অনেকেই ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। ফলে অনেক পরিবার নিঃস্ব হয়েছেন ও ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নিহতদের স্মৃতিচারণের পাশাপাশি জরুরিভিত্তিতে আহতদের সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করা সরকার এবং আমাদের সবার নাগরিক কর্তব্য। একইসঙ্গে, স্বাস্থ্য খাতের সংস্কারের মাধ্যমে অব্যবস্থাপনা দূর করে মানুষের দুর্ভোগ, হয়রানির অবসান ঘটাতে হবে।’
অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে ১৫টি দাবি তুলে ধরে লড়াকু ২৪। সেগুলো হলো–
১. জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সারা দেশের সব আহত শিক্ষার্থী-জনতাকে তালিকা প্রকাশ করতে হবে।
২. জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহতদের চিকিৎসা বলতে কেবল তাদের শারীরিক ক্ষতকে বিবেচনা করলে চলবে না। বরং আহত প্রত্যেক ব্যক্তির আর্থ-সামাজিক, মানসিক অবস্থা বিবেচনা করে তাদের যথাযথ চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি আহত ব্যক্তির সেবায় নিয়োজিত স্বজনদের ব্যয়ভারও সরকারকেই বহন করতে হবে।
৩. আহত-নিহতের পরিবারের মধ্যে যাদের আর্থিক অবস্থা তুলনামূলকভাবে বেশি খারাপ এবং দীর্ঘমেয়াদি পুনর্বাসন দরকার তাদের আলাদাভাবে চিহ্নিত করতে হবে। যাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে, তাদের বিকল্প কর্মসংস্থান দেওয়ার উদ্যোগ নিতে হবে। যারা দৃষ্টিশক্তি পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেছেন কিংবা প্যারালাইজড হয়ে গেছেন তাদের পরিবারের সদস্যদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে।
৪. গণঅভুত্থানে গুরুতর আহতদের মধ্যে যাদের জরুরিভিত্তিতে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেওয়া জরুরি, আর কালক্ষেপণ না করে অবিলম্বে সরকারের উদ্যোগে বিদেশে নেওয়া ও সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।
৫. আহতদের তথ্য সংগ্রহে প্রতিটি জেলাকেন্দ্রিক জরুরি তথ্য সংগ্রহ কমিটি গঠন করতে হবে।
৬. প্রত্যেক আহত রোগীর পরিবারের সঙ্গে এক থেকে দুই জন শিক্ষার্থী বা নাগরিক স্বেচ্ছাসেবীদের যুক্ত করার উদ্যোগ নিতে হবে। তারা একজন আহত ব্যক্তির দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে পূর্ণাঙ্গভাবে সুস্থ হয়ে ওঠা ও বিকল্প কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা পর্যন্ত সম্পূর্ণ প্রক্রিয়ায় পাশে থাকবেন।
৭. করোনার সময়ের মতো আহতদের সার্বিক চিকিৎসা পরিস্থিতি নিয়ে জনগণের উদ্দেশে ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে প্রতি সপ্তাহে স্বাস্থ্যব্রিফ করতে হবে।
৮. আহতদের মধ্যে যাদের আর্থিক অবস্থা শোচনীয় এবং গ্রামে বাড়ি তাদের দ্রুত ছাড়পত্র দিয়ে কিছুদিন পরপর চেকআপে আসতে না বলে বরং তাদের জন্য বিশেষায়িত আবাসিক চিকিৎসার তত্ত্বাবধানের ব্যবস্থা করতে হবে।
৯. যে সব আহত ব্যক্তি বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নিয়েছেন তা মওকুফ করতে হবে।
১০. আহতদের যথাযথ চিকিৎসা নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়কে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।
১১. দলীয় রাজনীতি থেকে বেরিয়ে এসে চিকিৎসকদের পেশাগত নৈতিকতার ওপর ভিত্তি করে সেবা দেওয়ায় সচেষ্ট থাকতে হবে। চিকিৎসকদের পেশাগত নৈতিকতা নিশ্চিত করতে সরকারকে নিয়মিত তদারকি করতে হবে।
১২. সরকারের তত্ত্বাবধানে সব সরকারি, বেসরকারি ও ব্যক্তি উদ্যোগের স্বেচ্ছাসেবা কার্যক্রমগুলোর সমন্বিত ও জবাবদিহিমূলক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে হবে। সব ক্ষেত্রে অর্থায়নের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।
১৩. জরুরিভিত্তিতে প্রত্যেক জেলায় সরকারি হাসপাতালে আহতদের জন্য জরুরি তথ্য ও চিকিৎসা সহায়তা কেন্দ্র খুলতে হবে।
১৪. আহত শিক্ষার্থী-জনতার চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের দীর্ঘসূত্রিতার অবসান ঘটিয়ে সরকারের তৎপরতা দৃশ্যমান করতে হবে।
১৫. জাতীয় পর্যায়ে অভিজ্ঞ ডাক্তারদের টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে, যারা কেবল আহতদের চিকিৎসায় পরামর্শ দেবেন ও নজরদারি রাখবেন।
সংবাদ সম্মেলনে আরও ছিলেন– নৃবিজ্ঞানী ও লেখক রেহনুমা আহমেদ, গবেষক ও সাংবাদিক সায়দিয়া গুলরুখ। এছাড়া আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ আবদুল্লাহর স্বজন আইউব আলী, গুলিবিদ্ধ মুরাদ ইসলামের স্ত্রী রানী ইসলাম ও গুলিবিদ্ধ মোহাম্মদ মিজানুর রহমান তাদের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন।