সরবরাহ কমের অজুহাত, বেড়েছে চিড়া মুড়ি গুড়ের দাম

বন্যাদুর্গতদের ত্রাণ সহায়তা দিতে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এক হয়েছে সব শ্রেণিপেশার মানুষ। সামর্থ্য অনুযায়ী রাজধানী তথা সারা দেশের মানুষ বন্যার্তদের সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছে। রাজধানীতে ‘গণত্রাণ’ সংগ্রহ কর্মসূচিতে রীতিমতো ঢল দেখা গেছে ত্রাণদাতাদের। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা এবং নগরীর বাসিন্দারা দলবদ্ধ হয়ে ত্রাণ সংগ্রহ করে ছুটছেন বন্যাদুর্গত এলাকায়।

চাহিদা বাড়ার ফলে এরইমধ্যে রাজধানীর বাজারে বেড়ে গেছে ত্রাণসামগ্রীর দাম। অভিযোগ আছে, মূলত সংকটের অজুহাত দেখিয়ে ব্যবসায়ীরা চিড়া, মুড়ি, গুড়, মোমবাতিসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় ত্রাণসামগ্রীর দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। পুরান ঢাকার মুদি দোকান থেকে শুরু করে চকবাজার, মৌলভীবাজার ও কাওরান বাজারে এসব জিনিসের দাম বাড়ার নমুনা দেখা গেছে। যদিও ব্যবসায়ীরা বলছেন, চাহিদার তুলনায় জোগান কম থাকায় দাম কিছুটা বেড়েছে।

সরেজমিন রাজধানীর বেশ কয়েকটি বাজার ঘুরে জানা যায়, বন্যার্তদের ত্রাণ সহায়তা দিতে কয়েক দিন ধরেই চিড়া-মুড়ি-গুড়-মোমবাতি কিনতে ভিড় জমাচ্ছেন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। শুকনো খাবার ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় পণ্যের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দোকানিরা সংকটের বাহানায় বেশি দামে এসব পণ্য বিক্রি করছেন।

মঙ্গলবার (২৭ আগস্ট) কবি নজরুল কলেজের শিক্ষার্থীদের একটি দল বন্যার্তদের সহযোগিতায় শুকনো খাবার কিনতে এসেছিল পুরান ঢাকার পাইকারি মার্কেট মৌলভীবাজারে। তাদের দলনেতা মেহেদী হাসান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমরা ৪০০ পরিবারকে সহযোগিতা করার উদ্দেশ্যে এখানে শুকনো খাবার কিনতে এসেছি। আগেও আমাদের ক্যাম্পাসের আরেকটা টিম বন্যার্তদের সহায়তায় করেছে। তারা যে দামে জিনিসপত্র, বিশেষ করে মুড়ি ও চিড়া কিনেছে, এখন একই দোকানিরা আমাদের কাছে বেশি দাম চাচ্ছে।

অতিরিক্ত দামে বিক্রি হচ্ছে চিড়া, মুড়ি ও গুড়

এই শিক্ষার্থী আরও বলেন, ব্যবসায়ীরা কেজিপ্রতি ৮-১০ টাকা বেশি দামে বিক্রি করছে মুড়ি। চিড়ার কেজি প্রায় ২০ টাকা বেশি। যেহেতু বন্যার্তদের সহযোগিতা করার উদ্দেশ্যে এসেছি, সেজন্য বাধ্য হয়ে বেশি দাম দিয়েই কিনতে হচ্ছে। চিড়া ও মুড়ি কিনলেও মোমবাতি কিনতে পারিনি। চকবাজার এলাকার সব দোকানেই খুঁজেছি, কিন্তু পাইনি। দোকানিরা বলছেন, চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম। চিড়া ও মুড়ির চাহিদা হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় এই সংকট দেখা দিয়েছে।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রায়হান আহমেদ এসেছিলেন বন্যার্তদের জন্য চকবাজার থেকে শুকনো খাবার কিনতে। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি ডিপার্টমেন্ট থেকে আলাদা করে বানভাসিদের জন্য সহযোগিতা করা হচ্ছে। আবার পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরাও এক হয়ে ত্রাণ দিচ্ছে। আমি আমার ডিপার্টমেন্টের পক্ষ থেকে দুইশত মানুষের জন্য শুকনো খাবার কিনতে এসেছি। এর সঙ্গে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, যেমন- মোমবাতি, ওষুধ এবং নারীদের জন্য প্যাড নিয়েছি।

রায়হান আহমেদ আরও বলেন, চিড়া ও মুড়ির সঙ্গে সঙ্গে গুড়ের দাম কেজিতে ১০ টাকা বেড়েছে। তাছাড়া চকবাজারের কোথাও মোমবাতি খুঁজে পাইনি। এক দোকানদার ম্যানেজ করে দিয়েছেন, তবে ১০ টাকার মোমবাতি ১৫ টাকা করে নিতে হয়েছে। দেশের এই পরিস্থিতিতে অনেক ব্যবসায়ী যেমন বন্যার্তদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন, তেমনই কিছু অসাধু ব্যবসায়ী এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে পণ্যের দাম বাড়িয়ে অধিক মুনাফা করছেন। ভোক্তা অধিকারের উচিত এই মুহূর্তে ভালোভাবে বাজার তদারকি করা।

বাজারে মোমবাতির সংকটের বিষয়ে চকবাজারের মোমবাতির পাইকারি ব্যবসায়ী জামাল চিশতি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, বর্তমানে বন্যার কারণে মোমবাতির চাহিদা তিনগুণ বেড়েছে। চাহিদার তুলনায় মোমবাতি সরবরাহ করতে পারছে না উৎপাদনকারীরা। ফলে আমরাও ক্রেতাদের দিতে পারছি না। আমরা যা পাচ্ছি তা বেশি দামে কিনে বিক্রি করতে হচ্ছে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরবরাহ কম থাকায় পাইকারি বাজারে এসব পণ্যের দাম বেশিবুধবার (২৮ আগস্ট) বিকালে কাওরান বাজারে সরেজমিন দেখা যায়, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে দলে দলে শিক্ষার্থীরা ত্রাণসামগ্রী কিনে ভ্যান ও পিকআপে তুলে নিয়ে যাচ্ছেন। সন্ধ্যানাগাদ এ দৃশ্য দেখা যায়। বিকালে কাওরান বাজারের কিচেন মার্কেটের নিচতলায় দেখা যায় চিড়া-মুড়ির দোকানে বেশ ভিড়। একটি দোকানে ১০০ কেজি মুড়ি আর ১০০ কেজি চিড়া কিনতে এসেছেন পাঁচ ব্যক্তি। তবে ব্যবসায়ী রমজান আলী ক্রেতাদের জানালেন, তার দোকানে চিড়া-মুড়ি কোনোটাই নেই। সন্ধ্যার পর তাদের যোগাযোগ করতে বললেন তিনি।

কাওরান বাজারে কিচেন মার্কেটে মুড়ি-চিড়া কিনতে এসেছেন তিতুমীর কলেজের একদল শিক্ষার্থী। তাদের কয়েকজন দোকান থেকে বস্তাভর্তি চিড়া কাঁধে করে নিয়ে ভ্যানে তুলছিলেন। তাদের একজন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, অগ্রিম টাকা দিয়েও চিড়া-মুড়ি কিনতে পারছি না। গুড়ের জন্য টাকা দিয়েছি দুদিন আগে। আজ কেবল দোকানদার জানালো গুড় এসেছে। তাও কেজি প্রতি ৩০ টাকা ব্যবধান। টাকা থাকলেও সব কিছু একসঙ্গে কিনতে পারিনি। এটা কী আসল অর্থেই সংকট, নাকি কৃত্রিম সংকট, তা কর্তৃপক্ষকে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।

চকবাজারের ব্যবসায়ী আব্দুল মতিন জানান, চিড়া মুড়ি, গুড় মোমবাতিসহ প্রায় সব জরুরি পণ্যের সংকট রয়েছে। দামও বেশি। কাস্টমার থেকে অ্যাডভান্স টাকা নিয়েও আমরা সময় মতো এসব পণ্য দিতে পারছি না। কারণ যেরকম চাহিদা সে পরিমাণে পণ্য পাচ্ছি না। তাছাড়া দামও বেশি দিতে হচ্ছে। বাজারে এসব পণ্যের যে সংকট তৈরি হয়েছে, আশা করি শিগগিরই তা কেটে যাবে।

কাওরান বাজার কিচেন মার্কেটের ব্যবসায়ী রবিউল ইসলাম বলেন, উৎপাদনকারীদের কাছ থেকে চাহিদা অনুযায়ী পণ্য পাওয়া যাচ্ছে না। ফ্যাক্টরিতে এসব মাল নেই বলে তারা সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। ওই ব্যবসায়ী আরও বলেন, আগে আখের গুড় প্রতি কেজি ১০০-১১০ টাকা কিনতাম। এখন সেটা ১২০-১২৫ টাকা করে কিনতে হচ্ছে। খোলা চিড়া মুড়িতেও কেজিপ্রতি পাইকারি ১০-১২ টাকা বেড়েছে। এরপরও পাওয়া যাচ্ছে না। যা আসছে তা দোকানে আসার আগেই বিক্রি হয়ে যাচ্ছে।