হিজড়া তৃতীয় লিঙ্গ নাকি ট্রান্সজেন্ডার, কী নামে ডাকবেন?

কী তাদের পরিচয়? একবার মৃদু স্বরে ডাকতে চেয়েছিল তৃতীয় লিঙ্গ, তারপর সরকারি নথিতে ডাকার পথ করে দেয় কেবল ‘হিজড়া’। আবার ট্রান্সজেন্ডার ও ট্রান্সসেক্সের ভুল ব্যাখ্যায় বারবার তৈরি হচ্ছে বিতর্ক। কিন্তু বিগত সময়ের কোনও সরকারই চেষ্টা করেনি বিষয়টি সুরাহা করতে। অধিকারকর্মীরা বলছেন, যদি ঠিক ব্যাখ্যাটা সবাইকে জানানোর চেষ্টা করতো— তাহলে এতবার বিতর্কের মুখে পড়তে হয় না। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংস্কারের ধারায় এই বৈষম্যটাকেও বিবেচনায় নেবেন বলে মনে করেন হিজড়া ও ট্রান্সজেন্ডাররা। আত্মপরিচয়ের অধিকার নিয়ে সুষ্ঠু আলাপের পরিবেশ সৃষ্টি হবে, এই প্রত্যাশা তাদের।

হিজড়া মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, সরকার আমাদের যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি দেওয়ার আশ্বাস দিয়েও সেটা করেনি। বিভিন্ন সময়ে সরকার, এনজিওসহ বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে ডাকা হচ্ছে, আলোচনা করা হচ্ছে, কোথাও কোথাও চাকরি পেয়েও টিকতে পারছে না। তারা বলছেন, আমাদের পরিচয় নিয়েই যদি বিভ্রান্তি তৈরি করে রাখা হয়, তাহলে বাকি অধিকার নিয়ে আমরা আওয়াজ তুলবো কী করে।

বৈষম্য দূর করতে ও সমাজের মূলধারায় সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে ২০১৩ সালের নভেম্বরে হিজড়া জনগোষ্ঠীকে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় সরকার। ২০১৪ সালের ২৬ জানুয়ারি হিজড়াদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ করা হয়। জাতীয় পরিচয়পত্র ফরমে হিজড়াদের জন্য ঘর রাখা আছে, তাহলে তৃতীয় লিঙ্গ ঘোষণার অর্থ কী দাঁড়ায়?

এ তো গেলো হিজড়া আর তৃতীয় লিঙ্গ। এখানেই শেষ না। ‘হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন নীতিমালা ২০১৩’-তে কী বলা হচ্ছে হিজড়ার সংজ্ঞায়? সরকারের এই নীতিমালা অনুযায়ী, হিজড়া শব্দের ইংরেজি পরিভাষা হচ্ছে ‘ট্রান্সজেন্ডার’।

গত বছর জুলাই মাসে সমাজে অবহেলিত হিজড়া জনগোষ্ঠীকে মাসিক ভাতা, পৃথক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও নাগরিক সুবিধা দিতে সরকারকে আইনি নোটিশ দেওয়া হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. মাহমুদুল হাসান এই নোটিশ দেন। ৩০ দিন সময় দিয়ে সমাজকল্যাণ সচিব, অর্থ সচিব, শিক্ষা সচিব ও আইন সচিব বরাবর নোটিশটি পাঠানো হয়। এতে বলা হয়, হিজড়ারা বাংলাদেশের সবচেয়ে অবহেলিত জনগোষ্ঠী। তারা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন, সমাজ থেকে অবহেলিত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে বৈষম্যের শিকার।

নারী অধিকার কর্মী মারজিয়া প্রভা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘‘নারী-পুরুষের সহজাত জেন্ডার আইডেন্টিটিকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করলেও আমরা ইতস্তত হই এর বাইরের কোনও জেন্ডার আইডেন্টিটিতে। তাই আমরা নারী-পুরুষের বাইরে অন্য যেকোনও জেন্ডার আইডেন্টিটিকে একত্রে তৃতীয় লিঙ্গ বলে ফেলি! এই সরলীকরণ করা মানে সব জেন্ডার বৈচিত্র্যের আলাদা আলাদা সংজ্ঞাকে নালিফাইড করে দেওয়া। এই তৃতীয় কথার মাধ্যমে আমরা স্বীকার করে নিই— প্রথম এবং দ্বিতীয় আছে। অবধারিতভাবে জেন্ডার হায়ার্কি আছে। আশ্চর্য যে এত জেন্ডার বৈচিত্র্যকে আমরা কর্নার করে তৃতীয় লিঙ্গ বা হিজড়া বলে একত্রীকরণ করতে চাচ্ছি। তাদের বৈচিত্র্যতাকে মাথাতেই নিচ্ছি না। অবধারিতভাবে তাদের বৈচিত্র্যতাকে ‘তৃতীয়’ বলে পুরুষ ও নারীর চেয়ে অধস্তন করছি।’’

ভুল ব্যাখ্যা করা বন্ধ করলে বিতর্ক বন্ধ হয়ে যাবে উল্লেখ করে অধিকারকর্মী জয়া সিকদার বলেন, ‘সরকারিভাবেই একেক জায়গায় একেক নামে জোর করে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে নানা সময়। তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হলো, প্রকল্প চলে হিজড়া নামে। তখনই আমরা বলেছিলাম— তৃতীয় লিঙ্গ আবার কী? পুরুষের শরীরে জন্ম নিয়েছে এমন কারও আচরণে বা চালচলনে নারীসুলভ (ফেমিনিন) ভাব থাকলে তাকে হিজড়া বলে চিহ্নিত করা হয়। এরা সবাই কিন্তু হিজড়া না। হিজড়া একটা সাংস্কৃতিক পরিচয়। ট্রান্সজেন্ডার মানেই অপারেশন করে রূপান্তর হওয়া নাও হতে পারে। হিজড়া কালচারে সবাই যে ট্রান্সজেন্ডার তাও না।’

তিনি বলেন, ‘টার্মগুলো সম্পর্কে মানুষের ধারণা কম। জেন্ডার ডাইভারসিটি নিয়ে আলোচনা হয় না। আমরা যা জানি সেটাই ঠিক মনে করে নিয়ে নিজের মতো করে ভাবি। ৯৮ শতাংশ মানুষ ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে থাকে যে হিজড়া প্রাকৃতিক আর ট্রান্স হলো লিঙ্গ পরিবর্তনের ফলে হয়। এটা যে একেবারে ভুল ধারণা, সেটা কেউ বলে না। সরকারের ডিলেমা, এ মানুষেরা কারা সেটা তারা স্পষ্ট করেনি। এই শব্দগুলোর সঙ্গে তারা একাত্মবোধ করতে চায় না। নারী-পুরুষের সমমর্যাদা হবে সমাজ, তা মানতে পারে না।’