‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ না ‘আদিবাসী’: বৈষম্য কি ঘুচবে?

আদিবাসী শব্দটি গত একযুগের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনদের কাছে তীব্র ‘স্পর্শকাতর’ এবং ‘অস্বস্তির’ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। একদিকে রাষ্ট্র তাদের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করে আসছিল। আরেক দিকে আদিবাসীদের তীব্র প্রতিবাদের জায়গা হয়ে দাঁড়িয়েছিল ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ হিসেবে চিহ্নিত না হতে চাওয়া। আদিবাসী নেতারা বলছেন,  ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বা উপজাতি শব্দগুলো বৈষম্য এবং বঞ্চনার প্রতীক হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। সব জায়গায় যখন বৈষম্যবিরোধী আচরণের দাবি উঠছে— তখন সেখানে আদিবাসীদের অধিকারের ক্ষেত্রে বৈষম্য থাকবে কেন?

আদিবাসী শব্দটি নিয়ে এ ধরনের সিদ্ধান্তের কারণ বিশ্লেষণে জানা যায়, এর পেছনে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার নিয়ে জাতিসংঘের একটি ঘোষণাপত্র দায়ী। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬১তম অধিবেশনে ২০০৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার নিয়ে একটি ঘোষণাপত্র অনুমোদিত হয়। সেখানে বাংলাদেশ, ভুটান এবং রাশিয়াসহ ১১টি দেশ ভোটদানে বিরত ছিল। সেই ঘোষণাপত্রে আদিবাসীদের ভূমি ও ভূখণ্ডের অধিকার নিয়ে কথা বলা হয়েছে। এই ঘোষণাপত্র স্বাক্ষর করার অর্থ হচ্ছে— এখানে যেসব বিষয় উল্লেখ করা আছে, সেগুলো মেনে নেওয়া এবং বাস্তবায়নের জন্য পদক্ষেপ নেওয়া। ফলে আদিবাসী শব্দটাকেই বিলোপ করে দেওয়া হয়েছে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এসব কারণেই বাংলাদেশ জাতিসংঘের ঘোষণায় স্বাক্ষর করছে না এবং ‘আদিবাসী'’ শব্দটিও মেনে নিচ্ছে না।

ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বিভিন্ন সংগঠন বলছে, ১৯৯০ দশকের শুরু থেকে আদিবাসী শব্দটি ব্যবহার করা হতো। তখন আদি বাসিন্দা হিসেবেই এটি ব্যবহার হতো। সে সময় বিষয়টি নিয়ে সরকারগুলো এতটা প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। কিন্তু যখন আদিবাসীদের অধিকারের বিষয়টি স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য জাতিসংঘে তোড়জোড় শুরু হয়, তখন সরকারও নড়েচড়ে বসে।

‘আদিবাসী শব্দ ব্যবহার না করার জন্য সরকারি যেসব পরিপত্র জারি করা হয়েছে, সেগুলো প্রত্যাহার করার দাবি করছি’, উল্লেখ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে অধিকার নিয়ে গত কয়েকদশক ধরে সোচ্চার ইলিরা দেওয়ান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এ দেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর চরম দুর্ভাগ্য যে, আগের সরকারগুলোর স্বৈরাচারিতার জাঁতাকলে পড়ে তারা নিজেদের পরিচিতিটুকুও নিজেরা নির্ধারণ করার অধিকার হারিয়ে ফেলেছে প্রায়।’ তিনি বলেন, ‘‘২০১০ সালে প্রণীত ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন, ২০১০’ এর দ্বারা সাংস্কৃতিক দিকটি স্বীকৃতি পেলেও আইনটিতে জাতিসত্তার পরিচিতি ও ভাষার স্বীকৃতির কথা বলা হয়নি। ফলে ২০১০ সাল থেকে এদেশের আদিবাসীদের ওপর ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর পরিচয় চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল।’’

ইলিরা দেওয়ান বলেন, ‘বর্তমান নির্দলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে আমাদের দাবি থাকবে, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর অস্তিত্ব সংরক্ষণ ও মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আওয়ামী আমলে জারি করা বৈষম্যমূলক পরিপত্রগুলো অচিরেই প্রত্যাহার করে নিয়ে এ দেশের বাঙালি ভিন্ন অপর ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলো যাতে তাদের নিজ নিজ পরিচয়ে পরিচিত হওয়ার অধিকার ফিরে পায়।’ তিনি আরও বলেন, ‘একইসঙ্গে দেশের ৫০টির বেশি ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জন্য মাত্র এক শতাংশ বরাদ্দ রাখার বিষয়টি অন্যায্য ও অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত। আমরা সব ধরনের সরকারি চাকরি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ৫ শতাংশ কোটা পুনর্বহালের জন্য জোর দাবি জানাচ্ছি।’

জোর করে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বলার যে চল শুরু হয়েছিল, এবার কি সেই বৈষম্য ‍দূর হবে প্রশ্নে আদিবাসী অধিকার কর্মী দীপায়ন খীসা বলেন, ‘‘আমরা মনে করি, বিগত সরকার বাংলাদেশের আদিবাসী জনগণকে অপমানসূচক ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’  পরিচিতি চাপিয়ে দিয়েছিল এবং একইসঙ্গে বাঙালিতে আত্মীয়করণ করে আমাদের  স্বীয় জাতিগত পরিচিতিকে বিলোপ করে দেওয়ার অপচেষ্টা করেছে। বর্তমান সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলীর মধ্যে বেশ কয়েকজন সদস্য রয়েছেন, যারা আমাদের লড়াইয়ে একসঙ্গে শামিল ছিলেন। সুতরাং, আমরা আশাবাদী— বর্তমান সরকার আদিবাসী জনগণের বঞ্চনার অবসান ঘটাতে সচেষ্ট থাকবেন।’’