হেফাজতে মৃত্যু বন্ধ হয়নি, সীমান্তে হত্যা বেড়েছে: আসক

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) বলেছে, দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যু বন্ধ হয়নি। সীমান্তে হত্যা বেড়েছে। সাংবাদিক নিপীড়নসহ মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বাধা দেওয়ার মতো ঘটনাও বন্ধ হয়নি।

২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে এক প্রতিবেদনে এ মন্তব্য করেছে সংগঠনটি।

আসকের চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্নার সই করা প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত গত ছয় মাসে গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে অন্তত দুই নারীসহ আট জনের মৃত্যু হয়েছে। এরমধ্যে যশোরের অভয়নগর থানায় পুলিশ হেফাজতে আফরোজা বেগম (৪০) নামে এক নারী মারা গেছেন। পরিবারের অভিযোগ, ঘুষের দাবিতে তাকে নির্যাতন করে হত্যা করেছে পুলিশ। গত ১ জুন রাত দেড়টার দিকে উপজেলার নওয়াপাড়া গ্রাম থেকে তাকে আটক করে থানায় নেওয়া হয়। আফরোজার ছেলে অভিযোগ করেন, তার মাকে বেধড়ক মারধর করা হয়েছে। এমনকি ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে নির্যাতনের কারণে অসুস্থ হয়ে মৃত্যু হয়েছে তার। যদিও পুলিশ তা অস্বীকার করেছে। কিশোরগঞ্জের ভৈরবে র‌্যাবের হেফাজতে থাকাকালীন সুরাইয়া বেগম (৫২) নামে এক গৃহবধূর মৃত্যু হয়। চিকিৎসকের বক্তব্য এবং গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে পরিবারের অভিযোগ, আটক ও জিজ্ঞাসাবাদের সময় শারীরিক নির্যাতনের কারণে ওই নারীর মৃত্যু হয়েছে।

ঝিনাইদহের শৈলকুপা থানা এলাকার ফিরোজ হোসেন নামে এক তরুণকে গত ৯ জুন শৈলকুপা থানা-পুলিশ মারধর করে এবং এক পর্যায়ে গুলি করে। গুলির ঘটনায় ফিরোজ হোসেন গুরুতর আহত হন এবং ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে তার হাত কেটে ফেলতে হয়। পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনে ঢাকার লালবাগ এলাকায় মো. ফারুক হোসেনের কারাগারে মৃত্যুর অভিযোগ করেছে পরিবার। এ ঘটনায় আদালতে নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে পরিবারের পক্ষ থকে। অন্যদিকে চট্টগ্রামে পুলিশের নির্যাতনে গুরুতর আহত হয়ে কারা হেফাজতে রুবেল দে নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়। পরিবারের পক্ষ থেকে এ ঘটনায় আদালতে নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ দুটি ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে পরিবারের দাবি অস্বীকার করা হয়েছে। এসব ঘটনায় প্রকৃত তথ্য উদঘাটনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করা আবশ্যক।

নাশকতায় মামলায় কারাবন্দি বাগেরহাট জেলা যুবদল নেতা কামাল হোসেন এবং কারাবন্দি নাটোর জেলা যুবদল নেতা এ কে আজাদের মৃত্যু হয়। আটকের পরে পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ করেছে পরিবার। অন্যদিকে, যশোরের এক যুবদল নেতা পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

সাংবাদিক নির্যাতন ও হয়রানি

গত ছয় মাসে ১৪৫ জন সাংবাদিক বিভিন্নভাবে নির্যাতন, হয়রানি, হুমকি, মামলা ও পেশাগত কাজ করতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হয়েছেন। এ ধরনের ঘটনা প্রকৃতপক্ষে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সংকুচিত করবে, সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে ভীতি ও নিরাপত্তাহীনতা তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে।

রাজনৈতিক সহিংসতা

বিগত ছয় মাসে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতা, সিটি করপোরেশন নির্বাচন এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতাসহ বিভিন্ন জায়গায় রাজনৈতিক সংঘাত ও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে ৪৪০টি। এতে নিহত হয়েছেন ৪১ জন এবং আহত হয়েছেন অন্তত তিন হাজার ৭৩৬ জন।

কারা হেফাজতে মৃত্যু

গত ছয় মাসে কারা হেফাজতে মারা গেছেন ৪৬ জন। এর মধ্যে কয়েদি ২০ জন এবং হাজতি ২৬ জন। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে সর্বোচ্চ ১৩ জন হাজতি এবং ১০ জন কয়েদির মৃত্যু হয়।

ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন

বিগত ছয় মাসে ২৭টি ঘটনায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ২০টি বাড়িঘরে হামলা-ভাঙচুর, পাঁচটি বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, ২১টি প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। অন্যদিকে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের একটি মন্দিরে।

নারীর প্রতি সহিংসতা

গত ছয় মাসে যৌন হয়রানিকেন্দ্রিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন ১৪৬ জন নারী ও পুরুষ। এর মধ্যে হামলার শিকার হয়েছেন ১১৩ নারী এবং ৩৩ জন পুরুষ। এর মধ্যে বখাটেদের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন ১০১ জন নারী। বখাটেদের উৎপাতকে কেন্দ্র করে সংঘাতে আহত হয়েছেন ৩৬ জন। যৌন হয়রানির কারণে একজন নারী আত্মহত্যা করেছেন। অন্যদিকে, যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে বখাটেদের হাতে চার জন পুরুষ হত্যার শিকার হয়েছেন।

ধর্ষণের শিকার হয়েছেন মোট ২৫০ নারী। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ১৪ জনকে। ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন তিন জন। এছাড়া ৫৮ জন নারীকে ধর্ষণের চেষ্টা চালানো হয়েছে। পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন মোট ২৬৯ নারী। এর মধ্যে ৮৪ জন নারী স্বামী কর্তৃক হত্যার শিকার হয়েছেন। পারিবারিক নির্যাতনের কারণে আত্মহত্যা করেছেন ৯৪ নারী। ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন ২৯৪ জন।

যৌতুককে কেন্দ্র করে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন মোট ৩৩ নারী। যৌতুকের জন্য শারীরিক নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে ১২ জনকে এবং যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছেন চার জন। এর মধ্যে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১৬ জন। এ সময় ১০ জন গৃহকর্মী বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার হন। তাদের মধ্যে পাঁচ জনের রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে।

শিশু নির্যাতন ও হত্যা

দেশের বিভিন্ন স্থানে গত ছয় মাসে ৬৩১ শিশু বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন ও হত্যার শিকার হয়েছে। এরমধ্যে হত্যার শিকার হয়েছে ২৩৯ শিশু এবং তিন জন ছেলে শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। আত্মহত্যা করেছে ৫০ শিশু। বিভিন্ন সময়ে মোট ৭৭ শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া ধর্ষণের শিকার হয়েছে ২৩ ছেলে শিশু।

সীমান্ত সংঘাত

২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে নিহত হয়েছিলেন ১০ জন, আহত হয়েছিলেন ১৪ জন। এ বছর ছয় মাসে সীমান্তে বিএসএফর গুলিতে নিহত হয়েছেন ১৩ বাংলাদেশি নাগরিক। এছাড়া আহত হয়েছেন ১১ জন।

অন্যদিকে মিয়ানমার সীমান্তে মর্টার শেলের আঘাতে একজন বাংলাদেশি এবং বাংলাদেশে আশ্রিত মায়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর একজন নিহত হন।

গণপিটুনিতে নিহত

ছয় মাসে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন ৩২ জন। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে ১৬ জন, রাজশাহী বিভাগে সাত জন, চট্টগ্রাম বিভাগে তিন জন, খুলনা বিভাগে দুই জন, বরিশাল বিভাগে একজন, ময়মনসিংহ বিভাগে দুই জন এবং সিলেট বিভাগে একজন নিহত হয়েছেন। ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে জুন মাসে গণপিটুনিতে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ২৪।

আসক মনে করে, মানবাধিকার লঙ্ঘন প্রতিরোধে আইনের শাসন ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা জরুরি। না হলে বিচারহীনতার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায় এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনজনিত ঘটনা বাড়তে থাকে। আসক রাষ্ট্রের কাছে নাগরিকের সব ধরনের মানবাধিকারের সুরক্ষা এবং ভুক্তভোগীদের ন্যায়বিচার দ্রুততার সঙ্গে নিশ্চিতের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছে।