‘ধর্মকে ব্যবহার করে’ ভোটে দীর্ঘদিন সুবিধা ভোগ করা যায় না— বিশ্বে এমনটাই বার্তাই দিয়েছে ভারতের এবারের নির্বাচন। এছাড়া গণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতা পরিবর্তনের একমাত্র মাধ্যম নির্বাচন। আর সবার চাপের পরেও এই নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণের করার মাধ্যমে ভারত গণতান্ত্রিকভাবে পরিপক্বতার পরিচয় দিয়েছে। এটি শিক্ষা হিসেবে নিতে পারে আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো।
শনিবার (৮ জুন) সম্পাদকদের শীর্ষ সংগঠন এডিটরস গিল্ড আয়োজিত ‘ভারতের নির্বাচন ও ভূ-রাজনীতি’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় এসব কথা বলেন দেশের বিশিষ্টজনেরা। গোলটেবিল বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন এডিটরস গিল্ডের সভাপতি মোজাম্মেল বাবু।
বৈঠকে আলোচকরা বলেন, ভারত এমন এক রাষ্ট্র, যার ভেতরে শক্তিশালী রাজনৈতিক দলগুলো নিজ নিজ এলাকায় প্রতিষ্ঠিত। তাই বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের রাজনীতিতে নির্বাচন শক্তিশালী ভূমিকা রাখে। তাই, নানা বৈরি পরিবেশের মধ্যেও ভোটে রায় দিয়েছেন দেশের মানুষ।
বৈঠকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘গণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতা পরিবর্তনের একটিমাত্র পথ নির্বাচন— এটা আমাদের দেশের নেতাদের বোঝা উচিত। নেতৃত্বের যে পরিপক্বতা এটি ভারত প্রমাণ করেছে। ভারত যে বৃহত্তর গণতন্ত্রের দেশ এবং পরিপক্ব গণতন্ত্র, সেটি তারা প্রমাণ দিয়েছে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, মোদি সাহেবের নির্বাচনে আমাদের আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা, যেটার জন্য আমি অনেক দেন-দরবার করেছিলাম, এটা আমাদের আরও জোরদার হবে। এর জন্য আমাদের দেশে প্রক্সি ওয়ার হবার সম্ভাবনা কম। এটাও আমাদের জন্য প্লাস পয়েন্ট।’
রাজনীতির বিশ্লেষক ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আব্দুল মান্নান বলেন, ‘ভারতে নানা রাজনৈতিক প্রতিকূলতা থাকার পরেও কোনও দল কিন্তু বলে নাই, আমরা নির্বাচন করবো না। এবং কেউ সংবিধানের বাইরে গিয়ে নির্বাচন চায় নাই, যেটা আমাদের দেশে কালচার হয়ে গেছে। আমরা সংবিধানের বাইরে গিয়ে নির্বাচন চাই এবং জয়ের একটা গ্যারান্টিও চাই। ভারতের নির্বাচনে কিন্তু কেউ এরকমটা চায় নাই। তবে এবারের মোদি সরকার দুর্বল হবে। কারণ, তার বিরোধী অনেক দলের সঙ্গে মিলে সরকার গঠন করতে হচ্ছে।’
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক এয়ার কমোডর (অব.) ইশফাক ইলাহী চৌধুরী বলেন, ‘আমিও মনে করি, এটা গণতন্ত্রের বিজয়। বিশ্বব্যাপী যখন গণতন্ত্র পিছিয়ে যাচ্ছিল, সেখান থেকে বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে ভারত ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বব্যাপী যারা গণতন্ত্র দেখতে চায়, তাদের জন্য এটা আশার বাণী। এছাড়া ভারতে সব দলের নির্বাচনে যাবার পেছনে একটা কারণ রয়েছে। তারা দীর্ঘদিন ধরে কিছু ইনস্টিটিউট দাঁড় করিয়েছে। যেমন- নির্বাচন কমিশন ও সাধারণভাবে বিচার বিভাগকে তারা স্বাধীন করেছে। এসবের ওপর জনগণের বিশ্বাস আছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আমরা বাংলাদেশে সেরকম সলিড ইনস্টিটিউট গড়ে তুলতে পারিনি।’
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শমসের মবিন চৌধুরী বলেন, ‘গত ৪ জুন ভারতের লোকসভা নির্বাচন হওয়ার পর, যত আলোচনা তর্কবিতর্ক হয়েছে, আমার মনে হয় না— বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে এরকম চার দিন আলোচনা- সমালোচনা হয়েছে। কারণ, করার সেই সুযোগও নেই। সেটাই বোধহয় আমাদের একটা শিক্ষনীয় বিষয়। তবে ধর্মের রাজনীতি বন্ধ হয়েছে, তা আমি মনে করছি না। কারণ, ভোটের হিসাবে বিজিপি মাত্র এক শতাংশ ভোট কম পেয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের যে সম্পর্ক, তা ধারাবাহিক আছে। তবে এখন আরও উন্নতি করা প্রয়োজন। পানির বণ্টন নিয়ে আলোচনা ওঠা উচিত।’
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান ড. জাইদী সাত্তার বলেন, ‘বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্ক অনেক উন্নতি হয়েছে। তবে ভারতের এই নির্বাচনের পরেও সেই সম্পর্কের খুব একটা পরিবর্তন হবে বলে আমি মনে করি না। বরং ভারত ও চীন উভয়ের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ঠিক রেখে চলাটাই ভালো হবে।’
সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমেদ বলেন, ‘ভারতের রাজনীতিতে ধর্মের প্রভাব কমেছে, এমনটা মনে করার কারণ নেই। সারা বিশ্বেই এটা আছে। তবে ধর্মীয় অন্ধতা, চরমপন্থা— এগুলো বেশি দূর নিয়ে যাওয়া যায় না। সবার স্বার্থ রেখে অসম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা যদি আমরা তৈরি করতে পারি, সেটাই সবার জন্য মঙ্গলজনক এবং সেটাই দেখতে পাচ্ছি বারবার।’
বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদক নঈম নিজাম বলেন, ‘নির্বাচনে ভারতীয় গণমাধ্যমের বড় ভূমিকা হলো— তারা নিজেদের ওইভাবে বিকিয়ে দেয় না। তারা চেষ্টা করে স্বাধীনভাবে থাকার। সারা বিশ্বেই কোনও না কোনও গণমাধ্যম কাউকে না কাউকে সাপোর্ট করে। প্রত্যেকের নিউজের ধরন আলাদা। সেখানে ভারতীয় প্রত্যেক গণমাধ্যম নিজ নিজ মতামত প্রকাশ করেছে। আরেকটি বিষয়, ভারতের নির্বাচন কমিশন তার দায়িত্বে কঠোর ছিল। কাউকে ছাড় দেয়নি, কোনও পক্ষপাতদুষ্ট ছিল না। এছাড়া এবারের নির্বাচনে ধর্মকে ট্রামকার্ড হিসেবে ব্যবহার করার প্রবণতা বন্ধ করে দিয়েছে জনগণ।’
গোলটেবিল বৈঠকে আইনজীবী ও গবেষক ড. ফারজানা মাহমুদ বলেন, ‘ভারতের রাজনৈতিক দলগুলো নানা চাপ ও কোনঠাসার পরেও গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রেখেছে। সেখান থেকে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো শিক্ষা নিতে পারে। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি তেমন কোনও সুফল আনে না। তাই আমাদের দেশের রাজনীতিতে জামায়াত থেকে দূরে থাকা আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য মঙ্গলজনক।’