‘রেস্তোরাঁপাড়া’ হিসেবে পরিচিত রাজধানী ঢাকার বেইলি রোড। প্রায় আধা কিলোমিটার সড়কের দুই পাশের ভবনগুলোতে গড়ে উঠেছে অসংখ্য খাবারের দোকান ও ছোট-বড় রেস্তোরাঁ। এসব আবাসিক বা বাণ্যিজিক ভবনে নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা হয়েছে শতাধিক রেস্তোরাঁ। অথচ এসব রেস্তোরাঁয় নেই শতভাগ অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা বা অবকাঠামো। ফলে অগ্নিদুর্ঘটনাসহ নানা ঝুঁকির আশঙ্কা রয়েছে। তারই এক জ্বলন্ত উদাহরণ চলতি বছরের ২৯ ফেব্রুয়ারি ‘গ্রিন কোজি কটেজ’ ভবনে লাগা ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা।
গত ২৯ ফেব্রুয়ারি রাতে বেইলি রোডে ‘গ্রিন কোজি কটেজ’ ভবনে লাগা আগুনের ঘটনায় ৪৬ জন মারা যায়। এর মধ্যে ২০ জন পুরুষ, ১৮ জন নারী এবং ৮ জন শিশু। সাত তলা এই ভবনটিতে ‘স্যামসাং’, ‘গ্যাজেট অ্যান্ড গিয়ার’ ও ‘ইলিয়ন’ নামে তিনটি শোরুম ছাড়াও প্রায় ১২টি রেস্তোরাঁ ছিল। ‘চায়ে চুমুক’, ‘শেক হোলিক’, ‘ওয়াফে বে’, ‘কাচ্চি ভাই’, ‘খানা’স’, ‘পিৎজা হাট’, ‘স্টিট ওভেন’, ‘জেস্টি রেস্টুরেন্ট’, ‘ফোকুস’ ও ‘হাক্কা ঢাকা’ রেস্তোরাঁ ছাড়াও ভবনটির ছাদে ছিল ‘অ্যাম্বোশিয়া’ নামে আরেকটি রেস্তোরাঁ।
ভয়াবহ এ অগ্নিকাণ্ডের পর নড়েচড়ে বসে ফায়ার সার্ভিসসহ সরকারি বিভিন্ন সংস্থা। বেইলি রোডসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার রেস্তোরাঁগুলোতে অভিযান চালানো হয়। কিছু রেস্তোরাঁ সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ থাকলেও মাসখানেকের মধ্যে আগের রূপে ফিরে আসে বেইলি রোডসহ রাজধানীর অন্যান্য এলাকার সব সব রেস্তোরাঁ। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, কিছু কিছু রেস্তোরাঁয় নামেমাত্র অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকলেও বেশিরভাগই ফায়ার সার্ভিসের নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করছে না। এছাড়া এসব প্রতিষ্ঠান দেখভালের দায়িত্বে থাকা সিটি করপোরেশন, রাজউকসহ অন্যান্য সংস্থার গাফিলতির বিষয়টিও প্রকাশ পায় গ্রিন কোজি কটেজে আগুন লাগার পর।
সরেজমিনে দেখা যায়, বাস্তবতার ধারে কাছেও নেই বেইল রোডের রেস্তোরাঁগুলো। এখনও বেশিরভাগ রেস্তোরাঁয় জরুরি বহির্গমন সিঁড়ি নেই। নেই পর্যাপ্ত অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা। এক্সটিংগুইশার সিলিন্ডার থাকলেও স্টাফরা সেগুলোর ব্যবহার জানেন না। অথচ ফায়ার সার্ভিস বলছে, যেকোনও প্রতিষ্ঠানের শতকরা ২৫ শতাংশ কর্মীর অগ্নিনির্বাপণ সরঞ্জাম ব্যবহার জানতে হবে।
বেইলি রোডে ‘ফখরুদ্দিন বিরিয়ানি অ্যান্ড কাবাব’, ‘ভুতের আড্ডা’, ‘নবাবি ভোজ ১’, ‘নবাবি ভোজ ২’, ‘ক্যাপিটাল’, ‘পিঠাঘর অ্যান্ড জ্যাগেরী রেস্টুরেন্ট’, ‘চিন চিন চাইনিজ’, ‘তাওয়া রেস্টুরেন্ট’ ও ‘ঢাকাইয়া কাবাব অ্যান্ড স্যুপ’ রেস্টুরেন্টগুলোতে কয়েকটি এক্সটিংগুইশার সিলিন্ডার ছাড়া তেমন কোনও অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা দেখা যায়নি। বিশেষ করে এসব রেস্তোরাঁয় জরুরি বহির্গমনের কোনও সিঁড়িও নেই।
১১ নম্বর বেইলি রোড নামে চারতলা ভবনের (সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুলের বিপরীতে) দোতলা ও তিন তলায় অবস্থিত সুলতান’স ডাইন রেস্টুরেন্ট। এই রেস্তোরাঁয় ওঠার জন্য রয়েছে একটি সরু গলি ও আড়াই-তিন ফুট চওড়া একটি সিঁড়ি। ফায়ার এক্সটিংগুইশারের কয়েকটি সিলিন্ডার ছাড়া আর কোনও অগ্নিনিরাপত্তা চোখে পড়েনি। সুলতান’স ডাইনের ম্যানেজার মানিক হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা এখানে শুধু বিক্রি করছি। ধানমন্ডি থেকে রান্না হয়ে আসছে। অগ্নিনিরাপত্তার বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। বাইরে দিয়ে একটি সিঁড়ি নির্মাণেও কাজ চলছে।’
‘বাইতুল আবেদীন শপিং সেন্টার’ নামে একটি পাঁচ তলা ভবনের চার তলা পর্যন্ত চারটি রেস্তেরাঁ ও তিনটি বেকারির দোকান রয়েছে। এ ভবনে একটি মাত্র সিঁড়ি থাকায় বাইরে থেকে স্টিলের নতুন একটি ‘আউট সিঁড়ি’ বানানো হয়েছে। তবে সিঁড়িটি ‘লোক দেখানো’ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ভবনের চার তলা থেকে বাইরে দিয়ে স্টিলের সিঁড়িটি নিচে নামানো হয়েছে। তবে সিঁড়িটি ওপরে প্রায় আড়াই ফুট প্রস্থ থাকলেও নিচের দিকে এসে দেড় ফুটে রূপান্তর হয়েছে। এদিকে এই ভবনে ক্যাফে ‘জেলাটেরিয়া’ ও ‘সেশিয়েট’ নামে দুটি রেস্তোরাঁয় কাস্টমাররা বাইরের সিঁড়িটি সরাসরি ব্যবহার করতে পারলেও ‘বার্গার এক্সপ্রেস’ ও ‘ওয়াসিস’ নামে রেস্তোরাঁর কাস্টমারদের ভিন্ন উপায় ব্যবহার করতে হবে জরুরি বহির্গমন সিঁড়ি। ক্যাফে জেলাটেরিয়া, সেশিয়েট, বার্গার এক্সপ্রেস ও ওয়াসিস নামে এই চারটি রেস্তোরাঁয় ফায়ার এক্সটিংগুইশার সিলিন্ডার ও কিছু ফায়ার বল ছাড়া আর কিছুই নেই।
ওয়াসিস ক্যাফে অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার মো. রাসেল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘একটা দুর্ঘটনা ঘটার পরে আপনারা এত তৎপর হন কেন? গত সাত বছরে আপনাদের একবারও দেখিনি। এখন এসব বিষয় বলতে বলতে আমরা বিরক্ত।’
বার্গার এক্সপ্রেসের ম্যানেজার মিলন বলেন, ‘গ্রিন কোজি কটেজে আগুন লাগার পর আমাদের ভবনের বাইরে দিয়ে একটা সিঁড়ি বানানো হয়েছে। কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে এ সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত বের হওয়া যাবে।’
সিঁড়ির গেট ‘বার্গার এক্সপ্রেসের কিচেনের’ ভেতর দিয়ে কেন করা হয়েছে, এমন প্রশ্নে মিলন বলেন, ‘এটা ভবন মালিক জানেন। এ ব্যাপারে আমরা কিছু বলতে পারি না।’
বাণিজ্যিক ভবনে রেস্তোরাঁ করায় কী ধরনের ঝুঁকি থাকে জানতে চাইলে স্থপতি মুস্তাফা খালিদ পলাশ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রেস্তোরাঁ আর অফিস ভবনের নকশা এক হতে পারে না। একটি ভবনের নকশা করা হয় তার ব্যবহারের ওপর ভিত্তি করে। কোনও ভবন অফিসের জন্য তৈরি করে রেস্তোরাঁর জন্য ভাড়া দেওয়া হলে, সাধারণ মানুষ তো এতকিছু বোঝে না যে, বিপদ ঘটলে কী হতে পারে। তারা নামি-দামি রেস্তোরাঁ দেখে সেখানে যায়।
রেস্তোরাঁয় চুলা ও সিলিন্ডারের ব্যবহার থাকায় বহুতল ভবনে রেস্তোরাঁ ব্যবসার জন্য স্পেস বা জায়গা ভাড়া দেওয়ার ক্ষেত্রে অগ্নিনিরাপত্তা যথাযথভাবে নিশ্চিত করার ওপর জোর দেন এই স্থপতি।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মেনটেন্যান্স) লে. কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, অগ্নিনিরাপত্তা জোরদারে আমরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে করণীয় পরামর্শ ও নিরাপত্তা জোরদারের নোটিশ দিয়ে থাকি। বিশেষ করে ফায়ার নিরাপত্তা ব্যবস্থা কেমন হবে এবং কী ধরনের সরঞ্জাম ব্যবহার করা প্রয়োজন। এছাড়া অগ্নিকাণ্ড ও যেকোনও দুর্ঘটনা মোকাবিলায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের কর্মরতদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়।
লে. কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ঢাকাসহ সারা দেশে ৪ লাখ ৩৩ হাজার রেস্তোরাঁ রয়েছে। এরমধ্যে ২০০ এর কিছু বেশি রেস্তোরাঁ ফায়ার লাইন্সেপ্রাপ্ত। বেইলি রোডের সবগুলো রেস্তোরাঁয় ফায়ার নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারের জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছে। বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসসহ সংশ্লিষ্ট সব তদারকি সংস্থার দায় আছে বলে মনে করেন ফায়ার সার্ভিসের এই কর্মকর্তা।