নিমতলী ও চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডি

স্বজন হারানোর শোকে আজও কাঁদছেন ভুক্তভোগীরা

ঘটনার দিন বাড়িটির সামনে দোকানে সাত বছর বয়সী ছেলে বৈশাখকে নিয়ে বসে ছিলেন মামুন (৪০)। হঠাৎ দেখেন সামনের ভবনে আগুন ধরেছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঘটে বিস্ফোরণ। কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয় চারদিক। শুরু হয় দিগবিদিক ছোটাছুটি-চিৎকার। বাবার পাশেই মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়ে ছেলে বৈশাখ। গুরুতর আহত হন তিনি।

সেই বাড়ির সামনে এখন ফল ও কবুতর বিক্রি করেন মামুন। দোকানে টাঙানো আছে প্রিয় সন্তান বৈশাখের ছবি। সেদিনের কথা মনে করে চোখ মুছতে মুছতে মামুন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ছেলে তো মারাই গেলো, আমি এক মাস ছিলাম হাসপাতালে। ছেলেকেও মাটি দিতে পারিনি। আমার হাত-পাসহ শরীরের ডান পাশ পুরোটা পুড়ে যায়। এখনও ক্ষত দাগে চুলকায়। আমি তো নিজের কষ্ট মুখ দিয়ে বলতে পারি। কিন্তু আমার স্ত্রী তো বোবা; দিনরাত শুধু ছেলের জন্য কান্না করে; তাকে কি বলে সান্ত্বনা দিই? বাবা হয়ে পাশে থেকেও ছেলেকে বাঁচাতে পারিনি। এর চেয়ে কষ্ট পৃথিবীতে আর কিছু আছে? বলেই অঝোরে কাঁদেন মামুন।

২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলীতে ঘটে যায় মর্মান্তিক অগ্নিকাণ্ড। সে ঘটনায় মামুনের ছেলেসহ নিহত হন ১২৪ জন। তবে এত বড় হতাহতের ঘটনায় থানায় শুধু সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়। আজও কোনও মামলা বা কোনও তদন্ত হয়নি।

ভুক্তভোগী পরিবার ও স্থানীয় ব্যক্তিরা জানান, ওই ঘটনার পর বংশাল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হয়। তবে কোনও মামলা বা কোনও তদন্ত হয়নি। তাই এত মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ীদের বিচারের সম্মুখীন করা হয়নি। পুরনো বাড়িটিই মেরামত করে সেখানে বসবাস করছে মানুষ। আগে পাঁচতলা থাকলেও এখন ছয়তলা করা হয়েছে।নিমতলী মোড়

নিমতলীর ৪৩ নম্বর বাড়িতে সেদিন রাত ৯টার দিকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। বাড়িটির নিচতলায় দুই বোন রুনা আর রত্না ও পাশের বাড়িতে আসমা নামে তিন মেয়ের বিয়ের আয়োজন চলছিল। রান্নার জায়গার পাশেই ছিল রাসায়নিকের গুদাম। প্রচণ্ড তাপে গুদামে থাকা রাসায়নিকের প্লাস্টিকের ড্রাম গলে যায়। মুহূর্তেই বিস্ফোরণে আগুন লেগে ঘটনাস্থলেই এক পরিবারের ১১ জনের মৃত্যু হয়।

আর সামনের ৫৫ নম্বর বাড়ির ছয়জন ও বিয়ের বাড়ি লাগোয়া বাড়ির আরও ছয়জনের মৃত্যু হয়। মুহূর্তে লাগা আগুন আশপাশের ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। শত শত মানুষের চোখের সামনে বহু মানুষ পুড়ে অঙ্গার হয়ে যায়। একে একে মারা যান ১২৪ জন। এ ঘটনায় পুড়ে যায় ২৩টি বসতবাড়ি, দোকান ও কারখানা। ১৪ বছর পার হলেও আজও হয়নি বিচার।

ঘটনার পর রুনা, রত্না ও আসমার বিয়ে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাদের স্বামীদেরও চাকরির ব্যবস্থা করে দেন। এ ছাড়া তার পক্ষ থেক ৭২টি পরিবারকে এক লাখ করে টাকা দেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য হাজি সেলিমের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছিল এক মাসের বাজার ও অন্যান্য সহায়তা। এরপর আজও আর কেউ তাদের খোঁজ নেননি। সে ঘটনায় ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর অধিকাংশই এই এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন অন্যত্র।

নিমতলী ট্র্যাজেডিতে নিহতদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ

মামুন বলেন, ‘ঘটনার পর তৎকালীন সংসদ সদস্য জালাল সাহেব ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে বললেও পরে আর কোনও ক্ষতিপূরণ পাইনি। প্রধানমন্ত্রীর টাকা আর হাজী সাহেব যতটুকু সাহায্য করেছেন, অতটুকুই। এখন সুদে ঋণ নিয়ে ব্যবসা চালাচ্ছি। ঘটনার এত দিন হয়ে গেলো, এখনও জানতে পারলাম না কে দোষী। সবাই টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ করেছে। এতগুলো মানুষের জীবনের দাম থাকলো কই?’

স্থানীয় পঞ্চায়েত সভাপতি হাজী মোহাম্মদ শহীদ মিয়া বলেন, ‘রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে কেমিক্যাল গোডাউন থাকবে না, তখন পঞ্চায়েত থেকে সভা করে কেমিক্যাল গোডাউন সবাইকে সরিয়ে নিতে বলা হয়। এরপর এলাকায় আর কেমিক্যাল গোডাউন নেই। ঘটনায় যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, অধিকাংশ পরিবারই এখন এখানে নেই। যারা আছে তারাও কষ্ট নিয়ে আছে। যারা আর্থিকভাবে দুর্বল ছিল, তারা এখন কোনোরকম বেঁচে আছে। অনেক পরিবার উপার্জনের মানুষ হারিয়েছে।

তিনি আরও বলেন, ১২৪ জন মারা গেলেও পরিবার ছিল ৭২টা। তাদের প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে ১ লাখ করে টাকা দেওয়া হয়েছে। ঘটনার পর মামলা হয়নি। ফলে কে দোষী, এটা জানা যায়নি। আমরা এখন প্রতিবছর পঞ্চায়েতের পক্ষ থেকে শোক অনুষ্ঠান করি। এখানে স্মৃতিস্তম্ভ করা হয়েছে।’

চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডি
নিমতলী ট্র্যাজেডির ৯ বছর পর ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ঘটে আরেক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড। এ ঘটনায় প্রাণ হারান ৭১ জন। সেদিন রাতে হঠাৎ বিকট শব্দে সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ঘটে। এতে চুড়িহাট্টা জামে মসজিদের সামনে অবস্থিত ওয়াহেদ ম্যানশনসহ আশপাশের ভবনে দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ে। ওয়াহেদ ম্যানশনে থাকা অবৈধ কেমিক্যালের কারণে আগুন ভয়াবহ আকার ধারণ করে। এ আগুনে যানজটে আটকে থাকা পিকআপ, প্রাইভেট কার, রিকশা, ঠেলাগাড়ি, মোটরসাইকেলসহ শতাধিক যানবাহন পুড়ে যায়। ঘটনাস্থলেই লাশ হন ৬৭ জন। আগুন লাগার ১৪ ঘণ্টা পর নিয়ন্ত্রণে এসেছিল। পরে নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৭১-এ এবং আহত হন অনেকে।

এ ঘটনায় নিহত জুম্মনের ছেলে মো. আসিফ বাদী হয়ে চকবাজার থানায় মামলা করেন। মামলায় ওয়াহেদ ম্যানশনের দুই মালিকে মো. হাসান ও সোহেল ওরফে শহীদসহ অজ্ঞাত আরও ১০ থেকে ১২ জনকে আসামি করা হয়। ওই বছরের ৭ এপ্রিল হাসান ও শহীদকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে অবশ্য তারা জামিনে মুক্তি পান। মামলার তদন্ত করে ২০২২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ৮ জনকে আসামি করে চার্জশিট জমা দেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা চকবাজার মডেল থানার ওসি আবদুল কাইউম।

মামলার আসামিরা হলেন ভবনের মালিক দুই সহোদর হাসান ওরফে হাসান সুলতান, সোহেল ওরফে শহীদ ওরফে হোসেন, রাসায়নিকের গুদামের মালিক ইমতিয়াজ আহমেদ, পরিচালক মোজাম্মেল হক, ম্যানেজার মোজাফফর উদ্দিন, মোহাম্মদ জাওয়াদ আতির, মো. নাবিল ও মোহাম্মদ কাশিফ। বর্তমানে সবাই জামিনে আছেন।

এরপর ২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি মামলার চার্জ গঠন করে আনুষ্ঠানিক বিচার কাজ শুরুর আদেশ দেন আদালত। বর্তমানে মামলাটি ঢাকার অষ্টম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন আছে। সংশ্লিষ্ট আদালতের পেশকার মো. মিলন জানান, মামলাটিতে প্রথম সাক্ষী বাদীর সাক্ষ্য গ্রহণ হয়েছে। পরবর্তী সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ ২৭ জুন হওয়ার কথা রয়েছে।

ঘটনায় ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা জানান, ঘটনায় তাদের কারও পরিবারের সদস্য হারিয়েছে। কারও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নষ্ট হয়েছে। তবে অধিকাংশ পরিবারই পায়নি ক্ষতিপূরণ। এমনিক ক্ষতিপূরণের টাকাও নয়ছয় করার অভিযোগ করছেন তারা।

ঘটনার দিন রাতে ওয়াহেদ ম্যানশনের সামনে দোকানে বসে ছিলেন আনোয়ার হোসেন মঞ্জু (৩০)। দগ্ধ হয়ে মৃত্যু হয় তার। বর্তমানে দোকানটি আবার চালু করেছেন তার ভাই সাজ্জাদ হোসেন দুলু। তিনি বলেন, ‘বাবার সম্পত্তি বিক্রি করে আবার দোকান চালু করেছি, পাঁচ বছরেও ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়নি। আমরা শুনেছি টাকা এসেছে কিন্তু টাকা হাতে পাইনি।’

চুড়িহাট্টায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে ডিএসসিসির তৎকালীন মেয়র সাইদ খোকন বেশ কিছু প্রতিশ্রুতি দেন। ২০২০ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ডিএসসিসি নিহত ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মধ্যে ২১ পরিবারের সদস্যদের দৈনিক মজুরিভিত্তিক (মাস্টাররোল) পরিচ্ছন্নতাকর্মীর চাকরি, চারটি পরিবারকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ বাবদ দুই লাখ টাকার চেক প্রদান ও দুটি পরিবারকে ডিএসসিসির আওতাধীন মার্কেটে দোকান বরাদ্দ দেওয়ার জন্য কাগজ দেন।

চুড়িহাট্টা অগ্নিকাণ্ডে নিহত ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্য এবং চুড়িহাট্টা একতা সংঘের সাধারণ সম্পাদক আশিক উদ্দিন সৈনিক বলেন, ‘২১টি পরিবারের সদস্যকে চাকরি দেওয়া হয়েছে। আর চারটি পরিবারকে দুই লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে কোনও পরিবার কোনও ক্ষতিপূরণ পায়নি। ঘটনার পর বিভিন্ন ব্যাংক প্রধানমন্ত্রীর তহবিলে ৩০ কোটি টাকা জমা দিলেও, কোনও ক্ষতিপূরণ পাইনি আমরা।’

ওয়াহেদ ম্যানশন

এ ঘটনায় মামলার বাদী মো. আসিফ বলেন, ‘ভয়াবহ সেই অগ্নিকাণ্ডের কথা ভাবলে এখনও গা শিহরে ওঠে। পাঁচ বছর হয়ে গেলো, এখনও বিচার হয়নি। আগুন লাগা ভবন সংস্কার করে আগের মতোই ব্যবসা চলছে। আসামিরা জামিন পেয়ে দেদার ঘুরে বেড়াচ্ছে। মাঝখান থেকে আমার বাবার মতো ৭১টি প্রাণ চলে গেলো। আশ্বাস দিলেও আজও কোনও ক্ষতিপূরণ পাইনি।’

নিমতলী চুড়িহাট্টার ভয়াবহ দুই অগ্নিকাণ্ড কাঁদিয়েছে গোটা দেশের মানুষকে। সমালোচনার ঝড় উঠেছে। বেঁচে যাওয়া অনেকে এখনও বয়ে বেড়াচ্ছেন শারীরিক ক্ষত। আবার অনেক পরিবার বুকে চেপে রেখেছে প্রিয় মানুষ হারানোর শোক। কিন্তু এক ঘটনার ১৪ বছর ও আরেক ঘটনার পাঁচ বছর পার হলেও স্বজন হারানো ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার কবে পাবেন বিচার, তা তারা জানেন না।

সরেজমিনে নিমতলী ও চুড়িহাট্টার দুর্ঘটনাস্থল ঘুরে দেখা যায়, মেরামত করে বাস-উপযোগী করা হয়েছে দুটি বাড়ি। সেখানে বসবাসও করছেন অনেকে। ব্যবসাও চলছে আগের মতো। তবে ঘটনার এত বছরেও বিচার না হওয়ায় এবং পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ না পওয়ায় ক্ষুব্ধ ভুক্তভোগী মানুষ, পরিবারের সদস্য ও এলাকাবাসী। তবে তাদের আকুতি, আর যেন এমন কোনও ট্র্যাজেডি না ঘটে কারও জীবনে, পুড়ে অঙ্গার হয়ে মরতে না হয় কাউকে।