জাদুঘরকে বলা হয় একটা জাতির ইতিহাস ঐতিহ্য সংস্কৃতির ধারক। গতিশীল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবেও চিন্তা করা যায় জাদুঘরকে। বলা হয়, কোনও দেশের জাদুঘর ভ্রমণ করলেই সে দেশের ইতিহাস ঐতিহ্য-সংস্কৃতি সম্পর্কে জানা যায়। নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে, মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে অবহিত করার লক্ষ্য নিয়েই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। ১৯৯৬ সালের ২২ মার্চ বেসরকারি উদ্যোগে ঢাকার সেগুনবাগিচার একটি ভাড়া বাসায় প্রথম মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর উদ্বোধন করা হয়। পরবর্তী সময়ে ২০১৭ সালের ১৬ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর আগারগাঁওয়ে নির্মিত নতুন ভবনে স্থানান্তর করা হয়। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বস্তুর এক দুর্লভ সংগ্রহশালা এই জাদুঘর।
১৯৪৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অব মিউজিয়াম (আইসিওএম)। এর সদস্য হিসেবে বর্তমানে বাংলাদেশসহ বিশ্বের মোট ১৮০টি দেশের ২৮ হাজার জাদুঘর যুক্ত রয়েছে। আইসিওএম-এর আহ্বানে দিবসটি ১৯৭৭ সালে প্রথম বিশ্বব্যাপী পালিত হয়। সেই থেকে প্রতিবছর দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। এ বছর বিশ্ব জাদুঘর দিবস ২০২৪ এর মূল প্রতিপাদ্যই হচ্ছে ‘মিউজিয়াম ফর এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ’। দিবসটি উপলক্ষে জাতীয় জাদুঘরে দিনব্যাপী থাকছে নানান আয়োজন।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ে প্রায় আড়াই বিঘা জমির উপর আধুনিক স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। যার পরতে পরতে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। এর ভেতরের গ্যালারিগুলো মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ ও ইতিহাসে রূপে সাজানো হয়েছে। প্রায় ২১ হাজার বর্গফুট আয়তনের চারটি গ্যালারিতে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবাহী নানা স্মারকের মধ্যে রয়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহিদদের ব্যবহৃত সামগ্রী, বিভিন্ন আলোকচিত্র, অস্ত্র, দলিল ও চিঠিপত্র।
প্রাচীন বঙ্গের মানচিত্র, পোড়ামাটির শিল্প, টেরাকোটা, নানা ঐতিহাসিক নিদর্শন, ব্রিটিশ আমল ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রেক্ষাপট এবং সত্তুরের সাধারণ নির্বাচনের নানা স্মারক সংগৃহীত আছে ‘আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের সংগ্রাম’ নামের গ্যালারিতে। ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের আলোকচিত্র, ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরোচিত হামলার নানা নিদর্শনও রয়েছে এই গ্যালারিতে।
এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে ‘আমাদের যুদ্ধ, আমাদের মিত্র’ নামের গ্যালারিতে যুদ্ধের সময় ভারতে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের জীবনযাত্রা, বিদেশি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের প্রিন্ট, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, রাজাকারদের তৎপরতা, মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলাযুদ্ধের আশ্রয়স্থল এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সহায়তাকারী দেশে–বিদেশের বিভিন্ন নিদর্শন রয়েছে। এছাড়াও এই জাদুঘরের ৯ তলা ভবনে আরও আছে গাড়ি পার্কিং ব্যবস্থা, আর্কাইভ, ল্যাবরেটরি, প্রদর্শন কক্ষ, অফিস এবং মিলনায়তন।
কোন ইতিহাসকে বহন করে নিয়ে যাওয়ার কাজটা মূলত করে থাকে নতুন প্রজন্মই। তাই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সাথে নতুন প্রজন্মকে সম্পৃক্ত করতে নিরন্তর কাজ করে চলেছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। এই সম্পৃক্ততা তৈরি করতে জাদুঘর কর্তৃপক্ষ করে থাকে বিভিন্নরকম কর্মসূচি। স্বাধীনতা দিবস ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে এখানে ৭ দিনব্যাপী উৎসব আয়োজন করা হয়। প্রতিদিনের অনুষ্ঠানেই ছাত্র-ছাত্রীরা অংশগ্রহণ করতে পারে। একইভাবে বিজয় দিবসেও সপ্তাহব্যাপী উৎসব করে কর্তৃপক্ষ। সেখানেও মূলত ছাত্রছাত্রীরাই অংশগ্রহণ করে থাকে।
কথা হয় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ব্যবস্থাপক (কর্মসূচি) রফিকুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রধান লক্ষ্যই হচ্ছে নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে, মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে অবহিত করতে। এই জাদুঘর প্রতিষ্ঠার পর থেকেই নতুন প্রজন্মকে, তারুণ্যকে, শিশু-কিশোরদেরকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের কর্মসূচি নিয়ে রফিকুল ইসলাম বলেন, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সবচেয়ে সফল দুটি কর্মসূচি হচ্ছে ‘আউটরিচ’ কর্মসূচি এবং ‘রিচ আউট’ কর্মসূচি। আউটরিচ কর্মসূচি হলো ঢাকা শহর এবং এর আশেপাশে যে সব স্কুল-কলেজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে সেসব শিক্ষার্থীদের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা। এক্ষেত্রে যাদের ট্রান্সপোর্ট তারা নিজস্ব উদ্যোগে আসবে। আর যাদের ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থা নেই মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর নিজস্ব গাড়ি দিয়ে নিয়ে এসে ভিজিট করাবে। আর তারা এসে একটা কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে। আর রিচ আউট কর্মসূচি হচ্ছে, আমাদের দুইটা ভ্রাম্যমাণ জাদুঘর। যেসমস্ত রাস্তায় সে গাড়ি যেতে পারে সেসমস্ত রাস্তায় আমরা সেই জাদুঘর নিয়ে যাই। এরকম করে আমরা ৬৪ জেলায় নিয়ে যাই। এরকম দুটি ট্রিপ আমাদের হয়ে গেছে।
আউটরিচ কর্মসূচি এবং রিচ আউট কর্মসূচির মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মকে ইতিহাসের সাথে সম্পৃক্ত করার কথা জানিয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, আমরা শিক্ষার্থীদের তাদের পরিচিতদের মধ্যে থেকে মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য সংগ্রহ করতে বলি। যারা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন তাদের ভাষ্যটা আমরা শিক্ষার্থীদের থেকে লিখিয়ে আনি। ছাত্র-ছাত্রীদের সংগ্রহ করা এরকম ভাষ্য এখন আমাদের এখানে প্রায় ৫৬ হাজার। এগুলো এখন আমাদের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ভান্ডারে জমা আছে। এগুলো আমরা ছাপার অক্ষরে ভলিউম আকারে বের করি। তারপর স্কুলগুলোতে পাঠিয়ে দেই এবং শিক্ষকদের সেগুলো পড়ানোর অনুরোধ জানাই। এরমধ্যে যেটা হচ্ছে শিক্ষার্থীরা যখন তার পরিবারের কিংবা তার বন্ধুর পরিবারের গল্পগুলো জানতে পারছে তখন কিন্তু সে তার নিজের এলাকার মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাগুলো জেনে যাচ্ছে। এরমধ্যে দিয়ে কিন্তু তারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সাথে কানেক্টেড হচ্ছে।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে সংরক্ষণ করছে জানিয়ে রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘কোনও ইতিহাসকে কে বহন করে নিয়ে যাবে? অতীত থেকে বর্তমান তার থেকে ভবিষ্যৎ, এই তরুণ প্রজন্মইতো নিয়ে যাবে। একটা প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করেছে, একটা প্রজন্ম সরাসরি যুদ্ধ করেছে এবং তার পরবর্তী প্রজন্ম শত বাঁধা এড়িয়েও ইতিহাসকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরতো তারই একটি বড় প্রতিষ্ঠান যে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে সংরক্ষণ করছে। আর সেই ইতিহাসকে যদি যুগ থেকে যুগান্তরে বহন করে নিয়ে যেতে হয় তাহলে তরুণ প্রজন্মকে সম্পৃক্ত করতে হবে।
কোনও ইতিহাস তখনই জীবন্ত হবে যখন তরুণ প্রজন্মের সম্পৃক্ততা বাড়বে। তাই এই প্রজন্মকে সম্পৃক্ত করতে কাজ করে চলেছে জাদুঘর কর্তৃপক্ষ। রফিকুল ইসলাম বলেন, জাদুঘর তো কোনও মৃত বস্তুর বা জড় বস্তুর সমাহার না, এটা চলন্ত, জীবন্ত। আর সেটাকে জীবন্ত রাখতে হলে অবশ্যই তাকে জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা ঘটাতে হবে। এক্ষেত্রে তরুণ প্রজন্ম যত বেশি সম্পৃক্ত হবে ইতিহাস তত বেশি জীবন্ত হবে, গতিশীল হবে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর এই কারণেই সব জায়গায় তরুণদের, শিশু-কিশোরদের প্রাধান্য দিয়ে থাকে।
জাদুঘরের গুরুত্ব তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘জাদুঘরের গুরুত্ব অপরিসীম। এটা আমরা না বুঝলেও যখন কোনও দেশে বহিঃশত্রু আক্রমণ হয়, তখন কিন্তু প্রথমেই জাদুঘরই লুট করে। ইরাকে আক্রমণের পরে কিন্তু প্রথম লুটটা জাদুঘরেই হয়েছে। কারণ সেখানে ব্যাবিলনীয় সভ্যতার বিভিন্ন নিদর্শন ছিল। জাদুঘর হচ্ছে একটা জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি। এটাকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবেও চিন্তা করা যায়। এবারের জাদুঘর দিবসের মূল প্রতিপাদ্য ‘মিউজিয়াম ফর এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ’। তো জাদুঘর কিন্তু একটা জাতির ইতিহাস ঐতিহ্য সংস্কৃতি বহন করে এগিয়ে নিয়ে যায়।
চলমান কর্মসূচির পাশাপাশি নতুন কী পরিকল্পনা করছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, জানতে চাইলে এই কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি আমরা একাত্তরের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে কাজ করে যাচ্ছি। এটা জাদুঘর একা পারবে না, এটা জাতীয়ভাবেই করা হচ্ছে। তবে এখানে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এছাড়া নতুন যে শিক্ষা কারিকুলাম আছে সেটা নিয়ে আমরা কাজ করছি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বিভিন্ন ডিজিটাল কন্টেন্ট তৈরির কাজ চলছে। আমরা এই ব্যাপারে একটি খসড়া তৈরি করেছি। এটা নিয়ে জাদুঘর, শিক্ষা বোর্ড এবং শিক্ষা অধিদফতরের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় কথা হচ্ছে। কারিকুলামে ক্লাসরুমে কীভাবে ডিজিটাল কন্টেন্ট নিয়ে কাজ করা যায় বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের পার্টটা, সেটা নিয়ে কথা হচ্ছে। আমরা আশা করি সরকার এই ব্যাপারটি দেখবে। কারণ আমরা চাইলে তো আর পারি না। কারণ এখানে শিক্ষা বোর্ড বা শিক্ষা অধিদফতরকে প্রয়োজন। আমরা আশা করছি তারা এটার অনুমোদন দিবেন।’
উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সাপ্তাহিক ছুটির দিন হচ্ছে রবিবার। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্য টিকেট মূল্য ৫০ টাকা, ৫ থেকে ১৮ বছর বয়সী হলে ২০ টাকা, সার্কভুক্ত দেশের দর্শনার্থীদের জন্য ৫০ টাকা ও বিদেশি দর্শনার্থীদের জন্য ৫০০ টাকা। গ্রীষ্মকালীন সময়ে প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত এবং শীতকালীন সময়ে সকাল ১০টা থেকে ৫টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে।
ছবি: প্রতিবেদক