পাঁচ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শিশু জানে না ‘দেশ’ দেখতে আসলে কেমন হয়। ২০১৭ সালে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর শিশুরা ক্যাম্পে জন্মাচ্ছে। ক্যাম্পেই বেড়ে উঠছে। কিন্তু দেশ আসলে কেমন, সে সম্পর্কে তাদের কোনও ধারণা নেই। কথায় কথায় দেশে ফিরতে চাইলেও তারা জানে না— সেখানেও এমন ক্যাম্পের মতো করেই থাকতে হবে কিনা, সেখানেও তাদের খাবার ও পড়ালেখার জোগান অন্যরা দেয় কিনা! সরেজমিনে কক্সবাজারের বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গিয়ে নানা বয়সী শিশুদের কাছে ‘দেশ কেমন হয়’ জানতে চাইলে উত্তর মেলে— ‘দেশ সুন্দর, দেশে নিজের ঘর আছে, মা বলেছে।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, বছরের পর বছর ক্যাম্পের ঘেরা জায়গায় অন্যের দেওয়া অন্ন-বস্ত্রের নির্ভরশীলতায় যে বড় হচ্ছে, তাকে কীভাবে দেশ বুঝানো যায়? দেশ মানে তো কেবল ভিটেমাটি না। ফলে বাবা-মা তাকে দেশ নিয়ে যা বলবে, সেটা শুনে শুনে সে শিখবে। তাদের কাছে দেশ সেটা, যেটা তারা জীবনে দেখেনি।
তবে আশ্রয়দাতা দেশও চায় না, সে এটাকে নিজের দেশ ভাবতে শুরু করুক। শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘একটা পরিস্থিতিতে তাদের ক্যাম্পে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে এবং ক্যাম্পে কখনোই সব সুবিধা দেওয়া হয় না।’
কুতুপালং ও উখিয়ার মোট ৪টি ক্যাম্পে শিশুদের দলে দলে ভাগ করে নিয়ে কথা হয় ২০টি শিশুর সঙ্গে। এদের সবার বয়স ১১ থেকে ১৭ বছর। মিয়ানমার থেকে আসার সময় এদের বয়স ছিল ৪ থেকে ১০ বছর। ছেলেদের দুটো ও মেয়েদের দুটো দলে প্রশ্ন ছিল— কেন দেশে ফিরতে চাও, তোমাদের দেশটা কেমন। তাদের সবার উত্তরই কাছাকাছি। তারা বলছে, বাবা-মা বলেছে, আমাদের ওখানে সব আছে। ফিরে গেলে ওখানে আমাদের এক ঘরে থাকতে হবে না। আমাদের দেশে ওই খানে তাদের নিজেদের ঘরবাড়ি, জমি আছে বলে তারা মা-বাবার কাছে রোজ শোনে। সেখানে একটা জায়গায় সবাইকে রাখা হয় না, এটাও শুনেছে। কিন্তু ওই জায়গাটা কেমন, তা তাদের স্মৃতিতে না থাকায়, তারা কল্পনা করতে পারে না।
দেশ বলতে কী মনে হয়, প্রশ্নে তাদের উত্তর ছিল না কোনও। কেউ এদিক-ওদিকে তাকায়, কেউ নিচে তাকিয়ে অপ্রস্তুত হাসি হাসে। তারপর ১২ বছরের মেয়ে বলে, ‘মনে হয় এমন কোনও জায়গা— যেখানে গেলে আমাদের কষ্ট থাকবে না।’ কিন্তু তারা (মিয়ানমার সরকার) তো চায় না সেখানে ফিরিয়ে নিতে, তাহলে কী হবে— জানতে চাইলে ১১ বছরের আফতাব বলে, ‘বাবা-মা যেতে চায়, আমিতো চিনি না, বলতে পারি না।’
রিমা ও আনিকের অভিজ্ঞতায় যা আছে বলে দাবি করছে, তা শোনা গল্প। এখানে যেভাবে অন্যের সহায়তায় বেঁচে থাকা— তার বাইরে জীবন কেমন হয়, তারা জানে না। কারণ, তারা যা যা ওপারের গল্প জানে, সেসব তাদের বিশ্বাস করানো হয়েছে। তারা কেউই প্রত্যক্ষ করেনি। প্রত্যক্ষ না করলেও এই যে বিশ্বাস করে বেঁচে থাকা, সেটা ওদের ট্রমার মধ্যে ঠেলে দেবে কিনা, প্রশ্নের জবাবে মানসিক চিকিৎসক মেখলা সরকার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ওদেশ তারা চেনে না, আর এদেশটাও তাদের না। অনেকটা ছিন্নমূল হিসেবে বড় হচ্ছে। শিশুর বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়ার মধ্যে তার আত্মপরিচয় তৈরি হয়— এই শিশুদের ক্ষেত্রে সেটা হচ্ছে না। যা কিনা সুষম মানসিক বিকাশের জন্য খুব জরুরি। সেটা যখন হবে না, তখন সে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে এবং আত্মবিশ্বাস হারায়। যখন তার আত্মবিশ্বাস তৈরি হয় না, তখন সেলফ রেসপেক্টের সমস্যা হয়। এই শিশুরা যখন বয়ঃসন্ধিকাল পার করবে, তখন সেই সমস্যাগুলো সে নিজে চিহ্নিত করতে সক্ষম হবে এবং পরিস্থিতির সঙ্গে মিলাতে না পেরে হয়রানির শিকার হবে। তার দেশ নেই, দেশে ঘর জমির যে স্বপ্ন তার পরিবার দেখায়, তা দৃশ্যমান না। শেকড় শক্ত না থাকলে নিজের ভবিষ্যৎ যখন সে দেখতে পায় না, তখন অপরাধ করে হলেও কিছু একটা করে দেখাতে চায়। এটা তার জীবনে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। এই শিশুদের নানাবিধ বিষয়ে সম্পৃক্ত করে, তাদের বেঁচে থাকার মানে শেখানো ও মানসিক বোঝাপড়ায় সহায়তা করার দিকে মনোযোগ দেওয়া জরুরি।
বেড়ে ওঠার সঙ্গে বাড়ছে হতাশা
দল গঠন করে ক্যাম্পে ফুটবল ম্যাচ হচ্ছে, গায়ে জার্সি, পায়ে বুট, কিন্তু এই খেলা— এই শরীরচর্চা তাদের কোনও কাজে আসবে না বলে মনে করে রোহিঙ্গা তরুণরা। ক্যাম্পে ইন্টারনেটের ব্যবস্থা আছে। গোটা বিশ্ব তারা ওই বন্দিদশায় বসে দেখতে পায়। দুনিয়ার কোথায় কী হচ্ছে খোঁজ রাখে। কিন্তু অনুভব করতে পারে না। আসলেই এরকম মুক্ত জায়গা আছে, বিশ্বাস হয় না তাদের।
এই বয়সী শিশুদের সংগঠিত করার কাজটি করেন— এমন একজন যুবক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এই প্রজন্মের সমস্যা এদের আবেগ বলে কিছু নেই। ওরা এত ছোট ছিল যে, ওপারের সহিংসতা মনে নেই, এপারে বড় হচ্ছে ক্যাম্পের হাজারো নিয়মে। এদের কোনও আবেগ কাজ করে না। এদের রাগ-ক্ষোভ আমাদের প্রজন্মের থেকে বেশি। এরা কাউকে বিশ্বাস করে না। ঘরে বাবা-মায়ের কাছে দেশে ফেরার কথা শোনে, সেটাই বলে। আসলে দেশ বিষয়ে কিছু জানে না।
মেরে ফেলেছে, কেটে ফেলছে, পুড়িয়ে ফেলেছে, এখন কী?
রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা কাজে যুক্ত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক রাহমান নাসির উদ্দিন। রোহিঙ্গা শিশুদের দেশভাবনার বিষয়ে বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘ক্যাম্পে যাদের জন্ম হয়, তাদের দেশভাবনায় দুটো বিষয় উঠে আসে— একটা হলো বাংলাদেশে জন্ম হয়েছে, এটা সত্য এবং জন্ম যেখানেই হোক, তার বাবা-মায়ের দেশই তার আসল দেশ। মিয়ানমার তার দেশ হলেও যেহেতু তাদের সেখানে মেরে ফেলেছে, কেটে ফেলছে, পুড়িয়ে ফেলেছে, তাই আর সেখানে ফেরা হচ্ছে না। বাবা-মা যতই তাদের দেশের কথা শোনান না কেন, এই প্রজন্ম আসলে সেখানে ফিরতে চায় না। কারণ, সে সেই দেশের সঙ্গে যুক্ততা বোধ করে না। ফেরার কথা যেটুকু বলে, সেটা তার বাবা-মায়ের দেশ বলে।’
ছবি: প্রতিবেদক
আরও পড়ুন: