জীবনসংগ্রামে থেমে নেই যারা

পুরো নগরী যখন গভীর ঘুমে নিমজ্জিত হয়, তখনই একদল নারী নাগরিকদের পরিচ্ছন্ন শহর উপহার দিতে নেমে পড়েন এই নগরীতে। যাদের কাছে রাত কিংবা দিন সবটাই সমান। নগরীর সেবায় নিয়োজিত এসব নারীর জীবনে রয়েছে বহু চড়াই-উতরাই। প্রতিনিয়তই তারা জীবনের সঙ্গে করছেন যুদ্ধ। যাদের অনেকেরই অজানা এই সংগ্রামের কথা।

ধুলোময় এই নগরীকে পরিচ্ছন্ন রাখতে কাজ করছেন সুরিয়া বেগম, রাশিদা বেগম, সুরভ জানের মতো বহু পরিচ্ছন্নতাকর্মী। তাদের সবার জীবনেই রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন গল্প ও সংগ্রাম।

বিশ্ব নারী দিবস (৮ মার্চ) উপলক্ষে কথা হয় তিন জন নারী পরিচ্ছন্নতাকর্মীর সঙ্গে, যারা জীবনের প্রতিকূলতাকে পেছনে ঠেলে টিকে থাকার লড়াই করছেন প্রতিনিয়ত।

সুরিয়া বেগম (৫০) ত্রিশ বছর ধরে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে কাজ করছেন। তার স্বামী মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন ছিলেন। দুই ছেলে ও তিন মেয়ে রেখে ২৫ বছর আগে মারা যান সুরিয়ার স্বামী। তারপর থেকেই তার জীবনযুদ্ধ শুরু। পাঁচ সন্তানকে লালন-পালন করে গড়ে তুলেছেন। পঞ্চম থেকে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত সব সন্তানকে পড়ালেখাও করিয়েছেন তিনি।

সুরিয়া বেগম বলেন, আমার স্বামী বেঁচে থাকতেই আমি পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ শুরু করি। স্বামী মানসিকভাবে অসুস্থ ছিল। এই ভালো তো এই খারাপ। তবে সুস্থ থাকলে কাজ করতো টুকটাক, অসুস্থ হলে পারতো না। তিনি মারা যাওয়ার পর আমি পাঁচটা বাচ্চাকে নিয়ে নতুনভাবে নেমে পড়লাম। চাকরির পাশাপাশি রাস্তার পাশে পিঠা বিক্রি শুরু করি, মানুষের বাসায় কাজ করি। এভাবেই বাচ্চাগুলোকে বড় করেছি।

উত্তর সিটি করপোরেশনের দেওয়া জায়গায় ঘর করে বর্তমানে সন্তানদের নিয়ে থাকছেন সুরিয়া। তিনি বলেন, আমার ছেলেরা এখন বড় হয়েছে, মেয়েদের বিয়ে দিয়েছি। ছেলেদের টাকা আর আমার টাকা দিয়ে সিটি করপোরেশনের দেওয়া জায়গায় ঘর করেছি। এখানেই এখন থাকছি। আমার ঘরে পানি ও বিদ্যুতের লাইন আছে। তবে গ্যাসের লাইন নেই। মাটির চুলার রান্না করেই খেতে হয়।

সুরিয়ার মাসিক আয় ১৭ হাজার টাকা। তিনি বলেন, আমাদের বেতন প্রতিদিনের হাজিরা হিসেবে দেয়। তবে আমরা মাস শেষে পাই। প্রতিদিন ভোর ৪টায় কাজে যাই, ঘরে ফিরতে ফিরতে সকাল ১০টা থেকে বেলা ১১টা বেজে যায়। এভাবেই কাজ করে যাচ্ছি। আমার জীবন চলে যাচ্ছে।

রাশিদা বেগম

রাশিদা বেগমের (৫২) তিন ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে পরিবার। তাদের মধ্যে একজন সৎছেলে। স্বামী মারা গিয়েছেন সাত বছর আগে। তিনি ২০ বছর ধরে উত্তর সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে কাজ করছেন। তার মাসিক বেতন ২৮ হাজার টাকা। স্বামীর রেখে যাওয়া ঋণ বেতন থেকেই পরিশোধ করেন তিনি।

রাশিদা বেগম বলেন, আমার স্বামী মারা গিয়েছেন সাত বছর আগে। মৃত্যুর আগে তিনি বিভিন্ন সময়ে ঋণ নিয়েছিলেন ১২ লাখ টাকা। এই ঋণ এখন আমি পরিশোধ করছি। আবার আমার ছোট ছেলে বেকার। তাকে আমার চালাতে হয়। ঋণ দিয়ে সংসার চালিয়ে ঘর ঠিক করতে পারি না। বৃষ্টি হলে চাল দিয়ে ঘরে পানি পড়ে।

তিনি আরও বলেন, সাত মাস হয়েছে এক্সিডেন্ট করে আমার পা ভেঙেছে। এখনও পুরোপুরি ঠিক হয়নি। হাঁটতে সমস্যা হয়। এই অবস্থায় কাজে যাচ্ছি। কাজে না গেলে তো বেতন পাবো না। তবে কাজে আমার ছেলে সহযোগিতা করে। আমি ওর সঙ্গে থাকি। হাজিরা মিস করা যাবে না। বড় ছেলে তার সংসার চালায়। আর আমি অন্য ছেলেদের নিয়ে আমার সংসার চালাই। কষ্ট হয় এখন কাজ করতে, তবু করে যাচ্ছি। আমি চাই স্বামীর রেখে যাওয়া ঋণ যেন শোধ করেতে পারি। এই ভার যেন সন্তানদের নিতে না হয়।

২১ বছর ধরে তিনি পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ করছেন সুরভ জান (৪৩)। অল্প বয়সেই বিয়ে হয়েছিল তার। স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন চার বছর আগে। বর্তমানে এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়েই তার সংসার। ছেলের বয়স ২২ বছর আর মেয়ের বয়স ১৩ বছর।

সুরভ জান

সুরভ জান বলেন, আমার ছেলের বয়স যখন পাঁচ মাস, তখন থেকেই আমি চাকরি করি। তখন স্বামী ছিলেন। সংসার চলছিল ভালোই। তিনি চলে যাওয়ার পর একটা ধাক্কা কাটিয়ে উঠেছি। আমিই এখন আমার সন্তানদের মানুষ করছি। ছেলেমেয়েকে পড়াশোনা করাচ্ছি। আমার মেয়ে এখন ক্লাস সেভেনে পড়ে, ছেলে মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়েছে। একাই ওদের দেখাশোনা করি। মেয়ের বাবা মেয়েকে টুকটাক খরচ দেয়।

তিনি বলেন, ১৭ হাজার টাকা বেতন দিয়ে বাচ্চাদের পড়াশোনা, খাওয়াদাওয়া, পানি বিল, বিদ্যুৎ বিল দিয়ে চলতে হয়। এত কিছু করে চলা কঠিন এখন। তবু চলছি।

তিনি অভিযোগ করে বলেন, আমরা পানির বিল দিই, কিন্তু আমাদের পানি ভালো না, পানিতে গন্ধ। আমরা অন্য জায়গা থেকে পানি এনে খাই। এখানকার পানি যে ফুটিয়ে খাবো, সেটাতেও সমস্যা। লাকড়ি খরচ হয়। আমাদের ভালো পানি দিলে অনেক উপকার হতো।

সুরভ জান বলেন, আমার মেয়েটা বড় হচ্ছে। ওর পেছনে এখন বাড়তি খরচ করতে হচ্ছে। ওর যাতে কোনও সমস্যা না হয়, তাই ওকে স্যানিটারি ন্যাপকিন দিই। আমাদের অনেক ম্যাডাম (এনজিও কর্মী) এসে বলেছেন স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করতে। নইলে মেয়ের বড় সমস্যা হতে পারে। তাই কষ্ট হলেও সাধ্যমতো চেষ্টা করি। কিন্তু এই আয়ে কি আর জীবন চলে?