চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যাকাণ্ড: ২৫ বছরেও শেষ হয়নি বিচার

১৯৯৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর সন্ত্রাসীদের গুলিতে খুন হন নব্বইয়ের দশকের জনপ্রিয় চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী। রাজধানীর বনানীর ১৭ নম্বর রোডের আবেদীন টাওয়ারে ট্রাম্পস ক্লাবের নিচে খুন হন তিনি। ওই ঘটনায় নিহত সোহেল চৌধুরীর ভাই তৌহিদুল ইসলাম চৌধুরী বাদী হয়ে রাজধানীর গুলশান থানায় হত্যা মামলা করেন। কিন্তু মামলার ২৫ বছর পার হলেও এখনও  আলোর মুখ দেখেনি বিচার।

তবে রাষ্ট্রপক্ষ আশা করছে, দ্রুত মামলাটির বিচার শেষ হবে এবং তার পরিবার ন্যায়বিচার পাবেন।

বর্তমানে মামলাটি ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-২-এর বিচারক এম আলী আহমেদের আদালতে সাক্ষ্য গ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে। সর্বশেষ গত ১৭ ডিসেম্বর মামলাটির সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য দিন ধার্য ছিল। কিন্তু ওই দিন কোনও সাক্ষী আদালতে উপস্থিত না হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য আগামী ৩০ ডিসেম্বর তারিখ ধার্য করেন।

মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সাদিয়া আফরিন শিল্পী বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ থেকে মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তির করার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছি। সাক্ষীরা ঠিকমতো আদালতে এলে এত দিনে মামলার রায় হয়ে যেতো। মামলাটির অনেক পুরনো হওয়ায় সাক্ষীদের খুঁজতে অনেক বেগ পেতে হচ্ছে। এখন পর্যন্ত মামলাটির ১০ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ করেছেন আদালত।

তিনি আরও বলেন, সাক্ষীদের জবানবন্দি আসামিদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ প্রমাণ করতে পেরেছে। আশা করছি, আদালত সব আসামির সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করবেন। একটু দেরিতে হলেও ভুক্তভোগীর পরিবার ন্যায়বিচার পাবে।

এদিকে আসামি আশিষ রায় চৌধুরী ওরফে বোতল চৌধুরীর পক্ষের আইনজীবী সেলিম আশরাফ বলেন, আসামির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ মামলার অভিযোগ প্রমাণ করতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। এখনও কোনও সাক্ষী বোতল চৌধুরীর নাম বলেনি। এমনকি মামলার বাদী তার জবানবন্দিতে এই আসামির নাম বলেনি। আসামি নির্দোষ। তাকে হয়রানি করার জন্য এই মামলায় জড়ানো হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, গত ১৩ নভেম্বর আশিষ রায় চৌধুরী ওরফে বোতল চৌধুরীকে জামিন দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। একই সঙ্গে এই মামলা ছয় মাসের মধ্যে বিচারিক আদালতকে নিষ্পত্তির নির্দেশ দেওয়া হয়। বর্তমানে তিনি জামিনে মুক্ত আছেন। আশা করি এই মামলার রায়ে আসামি খালাস পাবেন।

অন্যান্য আসামিপক্ষের আইনজীবীরা বলছেন, মামলাটি দীর্ঘ হওয়ায় আসামিরাও ভোগান্তির শিকার। অনেকেই মামলা পরিচালনা করতে গিয়ে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। মামলাটির দ্রুত নিষ্পত্তির দাবি জানান এই আইনজীবীরা।

জানা যায়, মামলাটি উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশে ১৬ বছর ধরে বিচারিক কার্যক্রম বন্ধ ছিল। এরপর মহামারি করোনাভাইরাসের প্রভাবে বন্ধ থাকে মামলার সব কার্যক্রম। ২০২২ সালের ২৮ আগস্ট ২১ বছর পর পুনরায় সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়।

চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন ওই সময়ের জনপ্রিয় চিত্রনায়িকা পারভিন সুলতানা দিতিকে। বিয়ের কিছু দিন পর তাদের সম্পর্কে ফাটল ধরে। ওই সময় মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন সোহেল চৌধুরী। জড়িয়ে পড়েন নেশার জগতে। একপর্যায়ে নেশা ও জুয়ায় ডুবে থাকতেন তিনি। সেই অন্ধকার জগতের অপরাধীদের সঙ্গে শুরু হয় বিভিন্ন বিষয়ে নিয়ে দ্বন্দ্ব। সেই দ্বন্দ্বের রেশ ধরেই অবসান ঘটে তার জীবনের।

১৯৯৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর বনানীর ১৭ নম্বর রোডের আবেদীন টাওয়ারে ট্রাম্পস ক্লাবের নিচে সন্ত্রাসীদের গুলিতে মারা যান নায়ক সোহেল চৌধুরী। ওই ঘটনায় সোহেল চৌধুরীর ভাই তৌহিদুল ইসলাম চৌধুরী রাজধানীর গুলশান থানায় হত্যা মামলা করেন।

মামলাটির তদন্ত শেষে ১৯৯৯ সালের ৩০ জুলাই গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী পুলিশ কমিশনার আবুল কাশেম ব্যাপারী ৯ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেন।

মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামিরা হলেন, এজাহারনামনীয় আদনান সিদ্দিকী, ট্রাম্পস ক্লাবের মালিক আফাকুল ইসলাম ওরফে বান্টি ইসলাম, ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাই ওরফে আব্দুল আজিজ, তারিক সাঈদ মামুন, সেলিম খান, হারুন অর রশীদ ওরফে লেদার লিটন ওরফে বস লিটন, ফারুক আব্বাসী, শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমন ও আশিষ রায় চৌধুরী ওরফে বোতল চৌধুরী।

আদালত সূত্রে জানা যায়, ২০০১ সালের ৩০ অক্টোবর ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করেন। এর দুই বছর পর মামলাটির বিচার দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য ঢাকার দুই নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়। ওই সময় আসামিদের মধ্যে একজন হাইকোর্টে রিট আবেদন দাখিল করেন। হাইকোর্ট বিভাগের তৎকালীন বিচারপতি এম এ মতিন ও সৈয়দ রিফাত আহমদের বেঞ্চ ২০০৩ সালের ১৯ নভেম্বর ওই রিট আবেদনে প্রথমে তিন মাসের জন্য নিম্ন আদালতে মামলাটির কার্যক্রম স্থগিত করেন। এরপর ২০০৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি রিটের রুলের নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত মামলাটির নিম্ন আদালতের কার্যক্রম স্থগিত করেন। ২১ বছর পর ওই রুলের নিষ্পত্তি হয়ে পুনরায় সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়।

মামলার তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, বনানীর এক ক্লাবে সোহেল চৌধুরী তার বান্ধবীকে নিয়ে গেলে আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের সঙ্গে তর্ক হয়। উত্তেজিত হয়ে নায়ক সোহেল চৌধুরী আজিজ ভাইকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন। সেদিন আজিজ মোহাম্মদকে হত্যার চেষ্টাও চালান সোহেল চৌধুরী। ঘটনার কিছু দিন পর আসামিরা সোহেল চৌধুরীকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। হত্যার দিন সোহেল চৌধুরী রাত ১টার দিকে বন্ধুদের নিয়ে ট্রাম্পস ক্লাবে ঢোকার চেষ্টা করেন। নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) তোফাজ্জল হোসেন তাকে ঢুকতে না দেওয়ায় তিনি ফিরে যান।

সেদিন রাত আড়াইটার পর সোহেল চৌধুরী ফের ক্লাবে ঢোকার চেষ্টা করলে শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন, মামুন, লিটন, ফারুক আব্বাস ও আদনান সিদ্দিকী তাকে লক্ষ্য করে গুলি চালালে ঘটনাস্থলেই তিনি মারা যান।