পার্বত্য চুক্তির ২৬ বছর: উভয় পক্ষে আজও আস্থাহীনতা ও অবিশ্বাস

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৬ বছর পূর্ণ হলো। পাহাড়ি জনপদে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর চুক্তি সই হয়েছিল। আঞ্চলিক সশস্ত্র সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সঙ্গে সরকার চুক্তিটি করেছিল পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর শান্তি, নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা ও জীবনমান উন্নয়নের জন্য। সরকারের পক্ষ থেকে ৭২টি ধারার ৯৮টি উপধারার ৮৬ উপধারা সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করেছে। চারটি আংশিক ও বাকি আটটি বাস্তবায়নের কাজ চলছে।

অন্যদিকে জনসংহতি সমিতির পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল সম্পূর্ণরূপে তারা অস্ত্র সমর্পণ করবে। কিন্তু একমাত্র প্রতিশ্রুতিটি তারা আজও রক্ষা করতে পারেনি। পরে আধিপত্য বিস্তারে নিজেদের মধ্যে গড়ে ওঠে আরও কয়েকটি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ। নিত্য অস্ত্রবাজি ও চাঁদাবাজি ছাড়াও নিজেদের মধ্যে সংঘাত, হানাহানি, অপহরণ ও প্রতিপক্ষকে হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা ঘটছে। 

চুক্তি সইয়ের পর সরকারের পক্ষ থেকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও যোগাযোগ অবকাঠামোসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়া হলেও, অস্ত্রবাজি, চাঁদাবাজি ও জাতীয় রাজনীতিতে জড়িত নেতা-কর্মীদের অপহরণ ও হত্যার কারণে পরস্পর সন্দেহ ও অবিশ্বাস রয়ে গেছে।

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর শান্তি চুক্তি সই হয়েছিল (ফাইল ছবি)

পাহাড়ে বসবাসরত সবাই ভেবেছিল, চুক্তির ফলে পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি ফিরে আসবে। পাহাড়ে বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও বাঙালিদের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠাসহ ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত বন্ধ হবে। কিন্তু ভূমি বিরোধসহ নানা কারণে পাহাড়ে বসবাসকারী বাঙালিদের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎও পরস্পরের মধ্যে আস্থাহীনতার অন্যতম কারণ বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্টরা।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে যত অগ্রগতি

সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরের তথ্য অনুযায়ী, দীর্ঘদিনের রক্তক্ষয়ী সংঘাত ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের একটি সময়োপযোগী পদক্ষেপ ছিল ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বরের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি, যা ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি’ হিসেবে পরিচিত। তখন সরকারের পক্ষে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন তৎকালীন সংসদের চিফ হুইপ আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ এবং পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর পক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) শীর্ষ নেতা জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা। চুক্তির ৭২টি ধারার ৯৮টি উপধারার ৮৬টি ইতোমধ্যে সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। চারটির আংশিক ও বাকি আটটি বাস্তবায়নের কাজ চলছে।

চুক্তিতে সই করেন তৎকালীন সংসদের চিফ হুইপ আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ ও জনসংহতি সমিতির শীর্ষ নেতা সন্তু লারমা (ফাইল ছবি)

হানা গেছে, চুক্তি স্বাক্ষরের পর তিন পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়িতে ব্যাপক উন্নয়নকাজ হাতে নেয় সরকার। বিশেষ করে যোগাযোগব্যবস্থায় বৈপ্লবিক উন্নয়নে স্থানীয়রাও বিস্মিত হয়। স্বপ্নের চেয়েও বেশি উন্নতি হয়েছে বলে দাবি করেন তারা। পার্বত্য চট্টগ্রামে যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ৩ হাজার ৫৯০ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণ করা হয়। পাবর্ত্য চট্টগ্রামের অরক্ষিত সীমান্ত সুরক্ষাসহ ওই অঞ্চলে বসবাসরত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নিরাপদ যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নে সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের তত্ত্বাবধানে তিনটি ধাপে এক হাজার ৩৬ কিলোমিটার সীমান্ত সড়ক নির্মাণের কাজ এখনো চলছে। প্রথম ধাপে ৩১৭ কিলোমিটারের মধ্যে ১৭৪ কিলোমিটারের কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। প্রথম ধাপের বাকি নির্মাণকাজ ২০২৪ সালের জুন নাগাদ শেষ করার পরিকল্পনা রয়েছে। ক্রমান্বয়ে দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপের কাজ শেষ করা হবে জানান সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরা।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে বাধাগুলো কী কী, জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী দীপঙ্কর তালুকদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৬ বছর পার হয়ে গেছে। এ চুক্তির জন্য জনসংহতি সমিতি নিজেদের একক কৃতিত্ব দাবি করতে পারে না। আমরাও পারি না। এর সঙ্গে জনগণের বড় সম্পৃক্ততা আছে। এ চুক্তি সম্পাদনের পেছনে গণমাধ্যমেরও বড় ভূমিকা রয়েছে। আমরা এটা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি।

এক হাজার ৩৬ কিলোমিটার সীমান্ত সড়ক নির্মাণের কাজ এখনো চলছে

তিনি আরও বলেন, বিগত ২৬ বছরে চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন না হওয়াটা খুবই দুঃখের ও কষ্টের। ব্যক্তিগতভাবে আমি যেহেতু এটার সঙ্গে জড়িত ছিলাম।

দিপঙ্কর তালুকদার বলেন, যারা চুক্তি করেছে, যারা চুক্তি মানে, তারাই তো চুক্তি বাস্তবায়ন করবে। আর যারা মানে না, তারা কীভাবে চুক্তি বাস্তবায়ন করবে? চুক্তি বাস্তবায়নের বড় প্রতিবন্ধকতা হলো ২০০১ সালে বিএনপির সঙ্গে যোগসাজশ করে জনসংহতি সমিতির নির্বাচন করা। এতে বিশ্বাস ও আস্থাবোধ তারা নিজেরা নষ্ট করেছে। এরপর তাদের লক্ষ্য হচ্ছে আওয়ামী লীগকে এ অঞ্চল থেকে নিশ্চিহ্ন ও উচ্ছেদ করা। আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করলে চুক্তি বাস্তবায়ন করবে কাকে দিয়ে?

ঝুলন্ত সেতু

তিনি আরও বলেন, তাদের লক্ষ্য হচ্ছে, এখানে তারা ছাড়া আর কেউ থাকবে না। এটাও চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নের অন্যতম প্রতিবন্ধকতা। তা ছাড়া উন্নয়নের কারণে পাহাড়ের মানুষ এখন চুক্তি নিয়ে ভাবেন না। তারা ভাবেন, কীভাবে তারা আরও উন্নত জীবন যাপন করবেন।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ফলে ওই এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে চুক্তির বেশির ভাগই বাস্তবায়ন করা হলেও জনসংহতি সমিতির পক্ষ থেকে একটিমাত্র প্রতিশ্রুতি ছিল, সম্পূর্ণরূপে অস্ত্র সমর্পণ করা। কিন্তু তারা সেটা করেননি। উপরন্তু বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পাহাড়ের শান্তি বিনষ্ট করছে। চুক্তি স্বাক্ষরকারী উভয় পক্ষ যদি তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে, তাহলেই কেবল পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি ফিরে আসতে পারে।