রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের দাবি

সড়কে বিশৃঙ্খলার পেছনে সুবিধাভোগী গোষ্ঠী, সমস্যা রাজনৈতিক

সড়ক পরিবহনে বিশৃঙ্খলার পেছনে একটি সুবিধাবাদী গোষ্ঠী রয়েছে, যারা নানা অজুহাতে সড়ক পরিবহন আইন বাস্তবায়ন করতে দিচ্ছে না। এই খাতে চাঁদাবাজি ও দুর্নীতির বিরাট সুযোগ থাকায় গোষ্ঠীটি হীনস্বার্থে সড়ক পরিবহন খাতে অব্যবস্থাপনা টিকিয়ে রাখছে। সমস্যাটি রাজনৈতিক হওয়ায় যখন যে দল ক্ষমতাসীন থাকে, তখন সেই দলের লোকজন সড়ক পরিবহন খাত নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে চাঁদাবাজি করে।

শনিবার (২১ অক্টোবর) ধানমন্ডিতে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলা হয়।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান এ আই মাহবুন উদ্দিন আহমেদ লিখিত বক্তব্যে বলেন, ‘সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে প্রাতিষ্ঠানিক এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক দুই ধরনের উদ্যোগ নিতে হয়। সরকার প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগের মাধ্যমে দক্ষ চালক তৈরি, চালকদের বেতন-কর্মঘণ্টা নির্দিষ্টকরণ ও বাস্তবায়ন, পরিবহন শ্রমিকদের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, মেয়াদোত্তীর্ণ ও ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন বন্ধ, অনুপোযুক্ত সড়ক মেরামত এবং সড়ক পরিবহন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সুশাসন নিশ্চিত করবে। অপ্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগের মাধ্যমে সমন্বিত পদ্ধতিতে সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরি করবে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জীবনমুখি সচেতনতামূলক প্রচারণা চালাবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক কোনও উদ্যোগই যথেষ্ট মাত্রায় বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এ জন্য সড়ক ব্যবহারকারী সাধারণ জনগণ যেমন সচেতন হচ্ছে না, তেমনই সড়ক পরিবহন ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না।’

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান বলেন, ‘রাজধানীর যানজট নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে অনেকগুলো ফ্লাইওভার, ওভারপাস, ইউলুপ, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। তারপরও রাজধানীর যানজট কমছে না বরং বাড়ছে। কারণ এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যথেষ্ট মাত্রায় স্টাডি করা হয়নি। রাজধানীর যানজট কমানো এবং যাতায়াতের সুবিধার জন্য সরকার মেট্রোরেল নির্মাণ করে আংশিক চালু করেছে। দুটি সাবওয়ে নির্মাণ শুরু হচ্ছে। রাজধানীতে যে পরিমাণে মানুষের চাপ বাড়ছে, তাতে মেট্রোরেল এবং সাবওয়ে রাজধানীর যানজট খুব বেশি কমাতে পারবে না। মেট্রোরেল ও সাবওয়েতে কয়েক লাখ কোটি টাকা ব্যয় করা হচ্ছে এবং হবে। এই বিপুল অর্থ ব্যয়ের সঙ্গে আর মাত্র ১০ থেকে ১২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে রাজধানীর সব পুরনো বাস প্রত্যাহার করে চার হাজার আধুনিক নতুন বাস এসি, নন এসি ও সাধারণ তিন ক্যাটাগরিতে বিভক্ত করে রুট ফ্রাঞ্চাইজি পদ্ধতিতে পরিচালনা করলে এবং বাসের জন্য আলাদা লেন ব্যবস্থা করলে প্রাইভেট গাড়ি ব্যবহারকারী বহু মানুষ বাসে চলাচল করবেন।’

তিনি বলেন, ‘রাজধানীর সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব বাস সার্ভিস বাধ্যতামূলক করতে হবে। প্রয়োজনে বাস ক্রয়ের ব্যবস্থা করতে হবে সরকারি লোনের মাধ্যমে। এতে প্রাইভেট গাড়ির ব্যবহার কমবে। বাইসাইকেল লেন তৈরি করলে কয়েক লাখ ছাত্র-যুবক বাইসাইকেলে যাতায়াত করবে। কারণ পুরো রাজধানী সাইকেল রেঞ্জের আওতায়। এসব উদ্যোগ গ্রহণ করলে রাজধানীর যানজট একেবারেই নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। যানজট কমলে মোটরসাইকেলও ব্যাপকভাবে হ্রাস পাবে। একইসঙ্গে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ এবং মফস্বল শহরকেন্দ্রিক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করলে রাজধানীমুখী জনস্রোতও কমবে। এসব সমন্বিত ও টেকসই উদ্যোগের ফলে রাজধানীর যানজট ব্যাপক মাত্রায় হ্রাস পাওয়ায় দেশে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বেগবান হবে।’

পৃথিবীর ধীরগতির শহরের তালিকার শীর্ষে উঠেছে মন্তব্য করে এ আই মাহবুন উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বর্তমানে রাজধানীর গণপরিবহন ৫৩ শতাংশ যাত্রী বহন করে। ব্যক্তিগত গাড়ি বহন করে ১১ শতাংশ যাত্রী। অথচ সড়কে ৭০ শতাংশের বেশি জায়গা দখল করে চলে ব্যক্তিগত গাড়ি ও রিকশা। যানজটের কারণে মানুষ বাধ্য হয়ে মটোরসাইকেল ব্যবহার করছে। রাজধানীতে এখন ১৩ লাখের বেশি মোটরসাইকেল। রিকশার হিসাব কেউ জানে না। এই পরিস্থিতিতে ঢাকা এখন পৃথিবীর ধীরগতির শহরের তালিকায় শীর্ষে উঠেছে।’

তিনি বলেন, ‘সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়, বিআরটিএ, বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা, সামাজিক ও নাগরিক সংগঠন সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে সেমিনার, গোলটেবিল বৈঠক, কর্মশালা ইত্যাদির আয়োজন করছে নিয়মিত। বিশেষ করে, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এবিএম আমীন উল্লাহ নূরী এবং বিআরটিএ চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার সড়ক পরিবহনে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য সব স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে বারবার বৈঠক করছেন। বৈঠকে নানা প্রকার সুপারিশ তৈরি হচ্ছে। কিন্তু সুপারিশসগুলোর অধিকাংশই বাস্তবায়ন হচ্ছে না। অর্থাৎ তাদের এই উদ্যোগকে সহযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে নিচ্ছেন না স্টেকহোল্ডাররা।’

তিনি আরও বলেন, ‘দেশে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়, কিন্তু সেই তদন্ত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন হয় না। সড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য কমিটি করা হয়, সুপারিশ প্রণয়ন করা হয়, কিন্তু যথারীতি এসবের কোনও বাস্তবায়ন হয় না। অর্থাৎ সড়ক নিরাপত্তার বিষয়টি কমিটি গঠন এবং সুপারিশমালা তৈরির মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে। এর ফলে প্রতিদিন অসংখ্য দুর্ঘটনা এবং বহু মানুষের প্রাণহানি ঘটছে।’

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের সুপারিশ

সড়ক দুর্ঘটনা বোধে বেশকিছু সুপারিশ জানিয়ছে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন। সেগুলো হলো– দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ বৃদ্ধি করতে হবে, চালকদের বেতন-কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করতে হবে, বিআরটিএ’র সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে, পরিবহন মালিক-শ্রমিক, যাত্রী ও পথচারীদের প্রতি ট্রাফিক আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে, মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন বন্ধ করে এগুলোর জন্য সার্ভিস রোড তৈরি করতে হবে, পর্যায়ক্রমে সব মহাসড়কে রোড ডিভাইডার নির্মাণ করতে হবে, গণপরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে, রেল ও নৌ-পথ সংস্কার করে সড়ক পথের ওপর চাপ কমাতে হবে, টেকসই পরিবহন কৌশল প্রণয়ন করতে হবে, সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ বাধাহীনভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।

সংবাদ সম্মেলনে আরও ছিলেন– রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের ভাইস চেয়ারম্যান সৈয়দ জাহাঙ্গীর, অধ্যাপক হাসিনা বেগম, মো. রাশেদ খান, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক মো. জিল্লুর রহমান, রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের জয়েন্ট সেক্রেটারি মো তৌফিকুজ্জামান, রিসার্চ অ্যান্ড ডিজিটাল ইন্টারভেনশন এক্সপার্ট আমিনুর রহিম প্রমুখ।