ফেসবুকজুড়ে বিজ্ঞাপনে ভরে গেছে ওজন কমানোর ট্যাবলেট ও জুস পাউডারের। নিয়মানুযায়ী কোনও ওষুধের বিজ্ঞাপন দেওয়া দণ্ডনীয় অপরাধ। আর জুস বা পাউডারকে যদি খাদ্যপণ্য বিবেচনা করা হয় তাহলে বিএসটিআই’র অনুমোদন দরকার। সেই অনুমোদন কি নেওয়া হয়? এসব প্যাকেটের গায়ে লেখা-ড্রাগ ও বিএসটিআই আওতামুক্ত।
কর্মকর্তারা বলছেন, যদি খাদ্যপণ্য ওষুধ আকারে ব্যবহারের কথা বলা হয় তবে অবশ্যই ওষুধ নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের অনুমোদন লাগবে। দিনের পর দিন এসব ওষুধ বিজ্ঞাপন দিয়ে ক্রয়-বিক্রয় চলছে কেবল বাংলাদেশ সায়েন্স ল্যাব কর্তৃক পরীক্ষিত– এই ঘোষণা দিয়েই।
যদিও সায়েন্স ল্যাব কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা স্যাম্পল অ্যানালাইসিস করে রিপোর্ট দিতে পারেন, কোনও অনুমোদন দেওয়ার এখতিয়ার তাদের নেই। এমতাবস্থায় ভুক্তভোগীরা জানেন না অভিযোগ করবেন কোথায়? আর অনলাইনের এই অবৈধ কেনাবেচা মনিটরই বা করবে কারা?
এদিকে দিন যত যাচ্ছে চা, কফি ও ট্যাবলেট খেয়েই স্লিম হতে চেয়ে ধরা খাওয়া মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। যারা এসব বিক্রি করছেন তাদের দাবি—তারা তাদের প্রোডাক্ট সায়েন্স ল্যাব থেকে পরীক্ষা করিয়ে নিয়েছেন। এটি এক্সট্রা ফ্যাট বার্ন করে, ওজন কমাতে সহায়ক এবং কোনও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। যদিও মাসে ১০ কেজি কমার আশ্বাসে পণ্য কেনা অনেকের দাবি, এই পণ্য ওজন তো কমায়ইনি বরং তাদের শারীরিক নানা সমস্যা তৈরি করেছে।
সায়েন্স ল্যাবে পরীক্ষা করলেই হলো?
এ ধরনের অবৈধ পণ্যের ক্ষেত্রে বারবারই বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট (বিএসটিআই) এবং বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা কর্তৃপক্ষকে (বিসিএসআইআর) মুখোমুখি দাঁড় করানো হয়। যদিও এদের যার যার কাজ ভিন্ন। প্রশ্ন হলো, সায়েন্স ল্যাবে কোনও স্যাম্পল পরীক্ষা করা হলে কি তাতে বিএসটিআইর অনুমোদন লাগে না?
বিসিএসআইআর গবেষণাগারের চিফ সায়েন্টিফিক অফিসার বরুণ কান্তি সাহা বলেন, আমাদের কোনও এখতিয়ার নেই কাউকে কোনও পণ্য বাজারজাত করতে বলার। ব্যবসায়ীরা স্যাম্পল দিলে আমরা সেটা পরীক্ষা করে রিপোর্ট দিতে পারি। আবার এই যে পরীক্ষিত লেখে এখানেও চালাকি আছে। প্রতিটা স্যাম্পল টেস্ট করালেই কেবল এটা লিখতে পারবে। একটা স্যাম্পল পরীক্ষা করিয়ে লিখতেই থাকে। আমাদের কোনও বাজার মনিটর নেই, লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষমতা নেই, আমরা কেবল অ্যানালাইসিস রিপোর্টটা দিই।
কখন খাদ্যপণ্যেরও ড্রাগ প্রশাসনের ছাড় লাগে
এই চটকদার বিজ্ঞাপন দেওয়া অনেকে চট্টগ্রাম থেকে ব্যবসা পরিচালনা করেন। এই পণ্য কোথা থেকে আনেন প্রশ্নে বেশিরভাগই বলেন, তারা ভারত থেকে এসে নিজেরা প্যাকেটজাত করে অনলাইনের মাধ্যমে বিক্রি করেন। চট্টগ্রামের ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের সহকারী পরিচালক এস এম সুলতানুল আরেফিনকে বিষয়টি অবহিত করা হলে তিনি বলেন, একেক সময়ে একেক রকমের প্রবণতা দেখা যায়। এখন মানুষ আর্টিফিসিয়ালি হলেও পাতলা দেখাতে চায়। এবং এসব ওষুধে তা সম্ভব, বিজ্ঞাপন দেখে তারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হচ্ছে। আমাদের যদি তাদের ঠিকানাগুলো দেন তাহলে জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
প্যাকেটে লেখা এক, বিক্রেতা বলেন আরেক
ন্যানো স্লিমিংয়ের জুস পাউডার অর্ডার করে বিক্রেতার কাছে জানতে চাওয়া হয় কীভাবে এটি খেতে হবে। বিক্রেতা জানান, এক কাপ কুসুম পানিতে এক চামচ পাউডার দিয়ে খালি পেটে থেকে হবে, একবেলা। ১০ দিন পরে অগ্রগতি জানাতে হবে। দুই দিন পরে চট্টগ্রাম থেকে পার্সেলটি হাতে পেয়ে প্যাকেট নেড়ে দেখতে গিয়ে চোখ আটকে যায় এর ব্যবহার বিধিতে। সেখানে স্পষ্ট বলা, দিনে দুই থেকে তিনবার খেতে হবে। একটু ভিজিয়ে রাখতে হবে। এটার সঙ্গে লেবু এবং আদার রসও দিতে হবে অল্প করে। এ সময় চিনি-মিষ্টি একেবারে খাওয়া যাবে না। মাংস খাওয়া বন্ধ রাখতে হবে এবং খাদ্যগ্রহণের পরপরই ঘুমানো যাবে না। ব্যবহারবিধি পড়ার পর আবারও যোগাযোগ করা হলে তিনি লেবু বা আদার রস দিতে বললেও বাকি কোনও কিছু বলেননি।
ভুক্তভোগীরা যাবে কোথায়?
পণ্য বিক্রির সময় বিক্রেতার পক্ষ থেকে দেওয়া কোনও আশ্বাস কাজে না লাগার কারণে আইনগত ব্যবস্থা নিতে চাইলে সাইবার ট্রাইব্যুনাল, সিআইডির সাইবার সাপোর্ট সেন্টারে গিয়ে ভুক্তভোগী চাইলে লিখিত অভিযোগ দিতে পারেন। সিআইডির সাইবার বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার রেজাইল মাসুদ বলেন, এ ধরনের বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ আরেকটু সতর্ক হয়ে কনটেন্ট যাচাই-বাছাই করলে মানুষ কম প্রতারিত হতো। যেসব ক্ষেত্রে মানুষ অনেক প্রতারিত হচ্ছে সেসব প্রতিরোধে আমরা উদ্যোগ নিই, সতর্কতামূলক কাজও করি। গ্রাহক পর্যায়েও সতর্ক থাকার বিষয় আছে। কেউ যদি মনে করেন প্রতারিত হচ্ছেন তাহলে ভোক্তা অধিকারের দ্বারস্থও হতে পারেন।
এই বিষয়ে অভিযোগ জানালে ব্যবস্থা নেবেন বলে জানিয়ে ভোক্তা অধিকার কর্মকর্তা মাসুম বিল্লাহ বলেন, ভোক্তা যদি তার অধিকার ক্ষুন্ন হয়েছে মনে করেন তবে অভিযোগ করতে পারেন। আমরা ব্যবস্থা নেবো। এমনকি চাইলে সাইবার সিকিউরিটির শরণাপন্নও হতে পারে। অনলাইনে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে পণ্য কিনতে প্ররোচিত করা ও অবৈধ ভুয়া পণ্য বিক্রির অভিযোগে শাস্তির ব্যবস্থা হতে পারে।
পুরোনো আইনে এই বিজ্ঞাপনদাতা ও বিক্রেতাদের শাস্তির মুখোমুখি করার সুযোগ নেই উল্লেখ করে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ ইউসুফ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমরা নতুন আইনের অপেক্ষা করছি। আগামী সেপ্টেম্বরে যে আইনটি পেতে যাচ্ছি সেখানে এগুলো ধরার সুযোগ থাকছে। তিনি বলেন, অতিরিক্ত ফর্সা করে দেবে, এক মাসে কয়েক কেজি ওজন কমিয়ে দেবে, এ ধরনের ওষুধ বিক্রি করতে হলে অবশ্যই ওষুধ প্রশাসনের অনুমোদন নিতে হবে।