শূন্য হাতে শুরু, সবশেষে আবার শূন্য!

২০০০ সালে শূন্য হাতে বরিশাল থেকে ঢাকায় আসেন মজিদ। লেখাপড়া খুব বেশি জানেন না, তবে মাথায় ঘুরতো ব্যবসা। তার মধ্যে কাপড়ের ব্যবসায় আগ্রহ ছিল বেশি। প্রথমে রাজধানীর বঙ্গবাজারে কাপড়ের মার্কেটে চাকরি নেন। লাভক্ষতির হিসাব বুঝে নিজেই শুরু করেন ব্যবসা।

মজিদের প্রতিষ্ঠানের নাম সিয়াম ফ্যাশন। এটি শিশুদের উন্নত মানের পোশাক প্রস্তুতকারক ও পাইকারি প্রতিষ্ঠান। এই সময়ের মধ্যে তিনি বঙ্গবাজারে পাইকারি ব্যবসায়ীদের মধ্যে একজন হয়ে ওঠেন। বিপুল সম্পদ গড়তে না পারলেও পরিবার নিয়ে সুখেই ছিলেন। কিন্তু গত ৪ এপ্রিল ভোরের আগুনে সর্বস্ব হারিয়ে তিনি আবার শূন্য হাতে ঘুরছেন পুড়ে যাওয়া দোকানের আশপাশে। তার মতো আরও অনেক ব্যবসায়ীর গল্পও একই!

শুধু মজিদ নন, রাজধানীতে খালি হাতে আসা অনেক মানুষের ভাগ্যবদলের গল্পের সাক্ষী এই বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স মার্কেট। অনেক মানুষের মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দেওয়া বঙ্গবাজার এখন যেন এক টুকরো মরুভূমি।

অগ্নিকাণ্ডের পর বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীরা (3)

ব্যবসায়ী মজিদের সঙ্গে কথা হয় বাংলা ট্রিবিউনের এই প্রতিবেদকের। তিনি বলেন, এই দীর্ঘ সময়ে বঙ্গবাজারে অনেক ব্যবসায়ীর উত্থান-পতন দেখেছি। অনেককে দেখেছি কোটি টাকা নিয়ে ব্যবসায় নামতে। কদিন পরে শূন্যহাতে ফিরে গেছে। আমি (মজিদ) দুই যুগ আগে বঙ্গবাজারে খালি হাতে আসি। এই সময়ের মধ্যে নিজেকে দাঁড় করিয়ে ফেলি। কিন্তু কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে পথে বসছি। এমনভাবে পথে বসবো, ভাবতেও পারিনি।

বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের ৪ নম্বর গলির ৩০০ নম্বর দোকানটি ছিল মজিদের। একই গলিতে তার আরও একটি দোকান চলতো ভাড়ায়। দুটি দোকানের গোডাউনও ছিল বঙ্গবাজারে। সেদিনের অগ্নিকাণ্ডে একটির মালামাল বের করতে পারলেও অন্যটির মালামাল পুড়ে যায়। আগুন লাগার পর খবর পেয়ে ছুটে আসেন মার্কেটে। কিন্তু কিছুই করতে পারেননি শেষ সম্বলটুকু পোড়ার দৃশ্য দেখা ছাড়া।

অগ্নিকাণ্ডের পর বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীরা (2)

ব্যবসার ধারণা দিয়ে মজিদ বলেন, যারা ব্যবসা বোঝে, তাদের বঙ্গবাজার মার্কেটে ক্যাশ-ক্যাপিটাল দরকার হয় না। আপনি একটু চোখ-কান খোলা রাখলেই লাখ লাখ টাকার ব্যবসা করতে পারবেন। এখানে টাকা দিয়ে ব্যবসা হয় না। বর্তমানে আমার কাছে বিভিন্ন ব্যবসায়ী ২০ থেকে ২২ লাখ টাকা পাবেন। আমিও অনেক ব্যবসায়ীর কাছে ২৬ থেকে ২৭ লাখ টাকা পাবো। কিন্তু আমার টাকা পাওয়ার সম্ভাবনা না থাকলেও মার্কেটে ব্যবসা করতে হলে অন্য ব্যবসায়ীদের টাকা তো দিতে হবে।

অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত সিমন কালেকশনের মালিক শরীয়তপুরের ফারুক ছোয়াল। বঙ্গবাজারে বড় ব্যবসায়ী ছিলেন। দীর্ঘ প্রবাস জীবন ফেলে ২০১৫ সালে এখানে ব্যবসা শুরু করেন। আট বছর ব্যবসা করার পর প্রতিষ্ঠিত করেন নিজেকে। সেদিনের সেই ভয়াল আগুনে সবকিছু শেষ হয়ে যায় তার।

অগ্নিকাণ্ডের পর বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীরা (1)

ফারুক ছোয়াল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, প্রতিবছর ঈদে ১০০ থেকে ১৫০ জন মানুষকে কাপড় দিতাম। আর আজ মানুষে আমার বাসায় কাপড়চোপড় কিনে দিয়ে গেছে। বলার কোনও ভাষা নেই। একজন মানুষের জীবনে এর থেকে আর বড় কষ্ট কী থাকতে পারে! রাত ১টার দিকে দোকান বন্ধ করে গেছি। তখনও আমি বড় ব্যবসায়ী ছিলাম। তার কয়েক ঘণ্টা পর সকাল ৮টা বাজে আমার সবকিছু শেষ হয়ে যায়। কেউ এমন পরিস্থিতির শিকার না হলে বুঝবে না কী কষ্টে আছি।

ফারুক বলেন, পরিবারে সচ্ছলতা ফেরাতে ২০০০ সালে বঙ্গবাজারে একটি দোকানে চাকরি নিই। যেই টাকা বেতন পেতাম, তাতে অসুস্থ বাবার চিকিৎসা করিয়েছি এবং পরিবারের হাল ধরছি। পরে আরও ভালো থাকার জন্য ২০০৫ সালে বিদেশ চলে যাই। ১০ বছর বিদেশ করে এসে সেই টাকা দিয়ে বঙ্গবাজারে আবার ব্যবসা শুরু করি। আট বছর পর এবার পথে বসলাম।

আবার যদি আল্লাহ মুখ ফিরে তাকান, এই আশা নিয়ে কাঠফাটা রোধে বসে আছি জানিয়ে ফারুক বলেন, এই মার্কেটে দুটি দোকান ও দুটি গোডাউন ছিল। সেটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমার কাছ থেকে এই মার্কেটের সাত-আট জন ব্যবসায়ী মাল কিনে ব্যবসা করতেন। আর আজ আমি অন্যের কাছ থেকে কয়টা মাল নিয়ে বসে আছি। অগ্নিকাণ্ডে তার প্রায় ৬০ লাখ টাকার মতো ক্ষতি হয়েছে বলে জানান।

অগ্নিকাণ্ডের পর বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীরা (4)

বঙ্গবাজার ব্যবসায়ীদের প্রধান ব্যবসার সময় শবে বরাতের পর থেকে ২০ রমজান পর্যন্ত। এ সময়ে প্রতিদিন ব্যবসায়ীদের গড়ে ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা বেচাকেনা হতো। ব্যবসায়ী ফারুক বলেন, ১৫ রমজান আসতে আসতে পার্টিদের কাছ থেকে টাকা প্রায় চলে আসতো। কিন্তু অগ্নিকাণ্ড এমন সময় ঘটল, তাতে সব শেষ হয়ে গেলো।

বঙ্গবাজারে ব্যবসার শুরুর গল্প বলছিলেন নিউ খান ফ্যাশনের মালিক ফরহাদ খান। তিনি বলেন, আপন বড় ভাইয়ের হাত ধরে ২০০৬ সালে এই মার্কেটে আসি। চার বছর ভাইয়ের সঙ্গে ব্যবসা করছি। পরে ২০১০ সালে নিজেই ব্যবসা শুরু করি। মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার আগ পর্যন্ত তিনটি দোকান ছিল আমার। সব কয়টির মালিক আমি। আগুন লাগার পর কিছু মালামাল বাঁচাতে পেরেছি। কিন্তু অধিকাংশ মালামাল পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আমার তিনটি দোকানে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলতেই চোখ ভিজে আসে তার।

ফরহাদ খান বলেন, এই মার্কেটে অধিকাংশ ব্যবসায়ী বাড়ি থেকে খালি হাতে এসেছেন। তারপর নিজেই দোকান নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছেন। আমার বেলায় ব্যতিক্রম নয়। আমি মার্কেটের বড় ব্যবসায়ী, অথচ আজ চৌকি পেতে বসে আছি। বঙ্গবাজারের প্রতিটি দোকানে কয়েকজন করে স্টাফ ছিল। এখন মালিক ও স্টাফ সবাই সমান। কারোর কোনও অবস্থা নেই। ব্যবসায়ীরা যেভাবে শূন্যহাতে ব্যবসা শুরু করেছেন, ঠিক সেই শূন্য অবস্থানে চলে এসেছি আবার।