রাজধানীর কলাবাগানে চিকিৎসক কাজী সাবিরা রহমান লিপি যে রাতে খুন হন, সেই রাতে তার সাবেক স্বামী এ কে এম সামছুদ্দিন আজাদ ও তার গাড়িচালকের মোবাইল ফোন ভোররাত থেকে সকাল পর্যন্ত বন্ধ ছিল। প্রায় পাঁচ ঘণ্টা দুজনের মোবাইল ফোন বন্ধ থাকার কারণ অনুসন্ধান করছে পুলিশ।
এমনকি ওই রাতে গাড়িচালক সাইফুল রাত কাটিয়েছিলেন সামছুদ্দিনের শান্তিনগরের বাসায়। এ নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে দুজন দিয়েছেন দুই রকম তথ্য। এতেও সন্দেহ বাড়ে তদন্ত কর্মকর্তাদের।
গত বছরের ৩১ মে কলাবাগানের ফার্স্ট লেনের একটি ভবনে ভাড়া করা ফ্ল্যাট থেকে চিকিৎসক সাবিরার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় নিহতের ভাই রেজাউল হক বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলাটি তদন্ত করছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
১৯ এপ্রিল সামছুদ্দিন আজাদকে গ্রেফতার করে পিবিআই। তিন দিনের রিমান্ডে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। বর্তমানে তিনি কারাগারে আছেন।
গ্রীন লাইফ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. কাজী সাবিরা রহমান লিপিকে গলাকেটে হত্যা করা হয়। এরপর ঘরে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। হত্যার রহস্য উদঘাটন না হলেও পুলিশ কিছু ক্লু পেয়েছে বলে জানিয়েছে।
মামলার অগ্রগতি জানতে চাইলে পিবিআই ঢাকা মেট্রো (উত্তর) বিশেষ পুলিশ সুপার মো. জাহাঙ্গীর আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা বেশকিছু তথ্য পেয়েছি। যাচাই বাছাই করা হচ্ছে। সন্দেহভাজনদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছি।’
একই সময়ে বন্ধ দুই মোবাইল
লিপি খুন হওয়ার রাতে ৪টা ২১ মিনিট থেকে পরদিন সকাল সাড়ে ৯টা পর্যন্ত তার সাবেক স্বামী সামছুদ্দিন আজাদ ও সামছুদ্দিনের গাড়িচালক মো. সাইফুলের ফোন বন্ধ ছিল। বন্ধের আগে মোবাইল ফোন দুটির লোকেশন ছিল শান্তিনগর এলাকাতেই। সামছুদ্দিনের বাসা সেখানেই। দ্বিতীয় স্ত্রীর মেয়েকে নিয়ে সেখানে থাকেন সামছুদ্দিন।
ওই রাতে সামছুদ্দিন ও তার গাড়িচালক মোবাইল ফোন বন্ধ করে কলাবাগানে এসেছিলেন কিনা সেই তথ্য জানার চেষ্টা করছে পিবিআই।
এর আগে গাড়িচালক সাইফুল কখনও সামছুদ্দিনের বাসায় রাত না কাটালেও সেই রাতে তিনি সামছুদ্দিনের বাসায় ঘুমিয়েছেন।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মোবাইল ফোন বন্ধের বিষয়ে সামছুদ্দিন বলেছে, ঘুমের জন্য মোবাইল বন্ধ রেখেছিল সে। একই বিষয়ে সাইফুলকে জিজ্ঞেস করলে, সে অন্য উত্তর দিয়েছে। তাদের উত্তরগুলো সন্দেহজনক।’
ওই রাতে গাড়িচালক কেন সামছুদ্দিনের বাসায় ঘুমিয়েছিলেন এ বিষয়েও দুজন দুই ধরনের উত্তর দিয়েছেন বলে জানান ওই কর্মকর্তা।
পিবিআইকে সামছুদ্দিন বলেন, ‘রাত বেশি হয়ে যাওয়ার কারণে সাইফুল বাসায় থাকতে চেয়েছিল। তাই তাকে ঘুমাতে দেওয়া হয়েছিল।’
একই বিষয়ে সাইফুলকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি পিবিআইকে বলেন, ‘ওটা কি আমার বাপ-দাদার বাড়ি! আমি সেখানে থাকবো কেন? আমাকে মালিক থাকতে বলেছেন।’
২৬ মিনিট ফোনালাপ
হত্যাকাণ্ডের আগের দিন ৩০ মে রাতে সাবিরা রহমান লিপি ও তার সাবেক স্বামী সামছুদ্দিনের মধ্যে ফেসবুক মেসেঞ্জারে ২৬ মিনিট ৪৭ সেকেন্ড কথা হয়। সেখানে তারা বিভিন্ন ব্যক্তিগত ইস্যু নিয়ে ঝগড়া করেছেন বলে জানা গেছে।
পিবিআই’র তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ বিষয়ে আরও জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন আছে।
আরও জানা গেছে, প্রথম বিয়ের কথা গোপন করেছিলেন সামছুদ্দিন। এ নিয়ে সাবিরার সঙ্গে বিয়ের পর থেকেই দ্বন্দ্ব ছিল তার।
১৯৯৮ সালে চট্টগ্রামের একটি মেডিক্যাল কলেজে পড়ার সময় উবাইদ উল্লাহ নামের এক চিকিৎসকের সঙ্গে সাবিরার বিয়ে হয়েছিল। ১৯৯৯ সালে সেই ঘরে এক ছেলের জন্ম হয়। ২০০৩ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান উবাইদ উল্লাহ। এরপর তিনি ছেলেকে বড় করা ও চিকিৎসা পেশা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
২০০৬ সালে সামছুদ্দিন আজাদের সঙ্গে সাবিরার বিয়ে হয়। সামছুদ্দিন সাবিরার পরিবারকে জানিয়েছিলেন, তিনি আগে বিয়ে করেছিলেন, ডিভোর্স হয়েছে। তার আগের সংসারে এক মেয়ে রয়েছে। তবে বিয়ের পর সাবিরা জানতে পারেন, সামছুদ্দিনের আরও একবার বিয়ে করেছিলেন। সেই ঘরেও তার এক মেয়ে রয়েছে। এ নিয়ে সাবিরার পরিবার ক্ষুব্ধ ছিল সামছুদ্দিনের ওপর।
সাবিরাকে ২০০৭ সালে তার মা নিজের কাছে নিয়ে আসেন। এর মধ্যে সামছুদ্দিন ও সাবিরার সংসারে এক কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। তবে তারা দুজন আলাদা থাকতে শুরু করেন।
সাবিরার সঙ্গে ছাড়াছাড়ির পর সামছুদ্দিন তার মেজো স্ত্রীর ঘরে জন্ম নেওয়া মেয়েকে নিয়ে শান্তিনগরে থাকতে শুরু করেন। এতেও সাবিরা ও তার পরিবার নিশ্চিত হয় যে, সামছুদ্দিনের সঙ্গে তার আগের স্ত্রীর যোগাযোগ ছিল।
কলাবাগানের ফ্ল্যাটের একটি কক্ষে ভাড়া থাকতেন সাবিরা। বাকি দুই কক্ষে থাকতেন দুই তরুণী। এর মধ্যে একজনকে কয়েকদফা জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পিবিআই।
পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা ওই তরুণীকে কয়েকবার জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। ঘটনার দিন সকালে তিনি শরীরচর্চায় বের হয়েছিলেন। বাসায় ফিরে সাবিরার কক্ষ থেকে ধোঁয়া বের হতে দেখে নিরাপত্তাকর্মীকে ফোন করেন তিনি। এরপর পুলিশ এসে সাবিরার লাশ উদ্ধার করে।’