নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে স্বামীকে বেঁধে রেখে গৃহবধূকে নিজ ঘরে নির্যাতন ও বিবস্ত্র করার ভিডিও রবিবার (৪ অক্টোবর) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হলে স্তব্ধ হয়ে যায় পুরো দেশ। প্রায় এক মাস আগের যৌন নিপীড়নের এই ভিডিওচিত্র আবারও সমাজে বিবদমান বর্বরতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। বিশ্লেষকরা বলছেন, বিচারহীনতার সংস্কৃতি আমাদের বারবার এ পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। আর ধর্ষণ বা নির্যাতনের পাশাপাশি সেটি ভিডিও করার প্রবণতা সমাজকে আরও ভয়াবহ ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। অপরাধী ভিডিও করার সময় নির্যাতনের শিকার নারীকে আরও হেয় করার বিষয়টি মাথায় রাখে, কিন্তু সেটি যে তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য হয়ে দাঁড়াবে, সেটি মাথায় রাখে না। কেননা, সে বিচার থেকে রেহাই পেয়ে যাবে বলে বিশ্বাস করে।
এই পরিস্থিতিতে স্তব্ধ দেশ যখন বিক্ষোভে ফেটে পড়ছে, তখনই সোমবার (৫ অক্টোবর) খবর আসে—গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় নবম শ্রেণির এক স্কুলছাত্রী ধর্ষণের শিকার হয়েছে এবং অভিযুক্তের বন্ধু ধর্ষণের দৃশ্য মোবাইলে ধারণ করেছে। অভিযোগে বলা হয়, আবারও যখন ডাকবে, তখন না এলে এবং ধর্ষণের কথা কাউকে বললে, ধারণকৃত ভিডিও ফেসবুকে ছেড়ে দেওয়া হবে বলে হুমকি দেওয়া হয় শিক্ষার্থীকে।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব বলছে, জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে দেশে মোট ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৯৭৫টি। এ সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে জুন মাসে ১৭৬টি। ওই মাসে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটে ৩৯টি।
যেকোনও অপরাধ ভিডিও করা এবং সেটি অনলাইনে ছেড়ে দেওয়াকে সামাজিক ক্ষত হিসেবে উল্লেখ করে সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগের এডিসি নাজমুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কেবল ধর্ষণ না, অন্য অনেক ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে ভিডিও করে সেটি ছেড়ে দেওয়া, বা ছেড়ে দেওয়ার হুমকি প্রদানের মতো বিষয়গুলো লক্ষ করা যাচ্ছে। এদের বেশিরভাগের বয়স ১৬ থেকে ২৪-এর ভেতরে। এটি আমাদের সমাজের একটি দৈন্য দিক প্রকাশ করে।’ তিনি আরও বলেন, ‘পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট আছে। তাতে যথেষ্ট শাস্তির ব্যবস্থা আছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী স্যুমটো বা সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে সেসব নিয়ে কাজ করছে। কোনও ঘটনা প্রকাশিত না হওয়া পর্যন্ত আসলে কিছু করার থাকছে না। ফলে ইন্টারনেট ব্যবহারের এথিক্স নিয়ে কাজ করার সময় এসেছে। সচেতনতা বাড়াতে নানা কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। ইতোমধ্যে আমাদের পক্ষ থেকে কাজটি শুরু হয়েছে।’
ভিডিওগুলো অপরাধের সাক্ষ্য হিসেবে ব্যবহার হতে পারে—সেই ভয় অপরাধীদের নেই উল্লেখ করে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এই ভয় না থাকার কারণ তারা এতটাই বেপরোয়া যে তাদের ধারণা কেউ তাদের কেশাগ্র স্পর্শ করতে পারবে না।’ তিনি বলেন, ‘পেশীশক্তি, রাজনৈতিক শক্তি বা দুটো মিলিয়ে যে শক্তি, তা যখন একসঙ্গে হয়, তখন ব্যক্তি এ ধরনের বেপরোয়া হয়ে ওঠে। বিচার হবে না এটা ভেবে নিয়েই অপরাধী পরবর্তীতে সেই ভিডিও ব্যবহার করে ব্ল্যাকমেইলিংয়ের জন্যই ভিডিও ধারণ করে।’ এ থেকে মুক্তির উপায় কী প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘রাজনীতিবিদদের দায়িত্ব নিতে হবে। রাজনীতি থেকে অপরাধী চক্রকে বের করতে হবে। তা করতে ব্যর্থ হলে সমাজ আগামীর দিনে আর প্রগতির পথে এগুবে না। যদি আমাদের রাজনীতিকরা সেটি করতে ব্যর্থ হন, তাহলে আমরা প্রতিটা ইস্যু থেকে হয়তো সাময়িক মুক্তি পাবো, কিন্তু স্থায়ী মুক্তি মিলবে না।’