করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে সরকারের নির্বাহী বিভাগের জারি করা সাধারণ ছুটির সঙ্গে বিচার বিভাগও বন্ধ হয়ে যায়। ফলে গত ২৬ মার্চ থেকে ব্যাহত হয় আদালতের নিয়মিত কার্যক্রম। যদিও এ সময়ের মধ্যে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা থাকায় দেশের নিম্ন আদালতগুলোর মধ্যে চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত এবং চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত সীমিত আকারে খোলা রাখা হয়। বিচার বিভাগের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আদালতগুলো বন্ধ থাকায় একদিকে যেমন নতুন করে মামলা দায়েরের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়, তেমনই মামলার জট নিরসনে আদালতের বিভিন্ন উদ্যোগও থেমে যায়।
দীর্ঘদিন আদালত বন্ধ থাকায় এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে দেশের কয়েকটি আইনজীবী সমিতির সদস্যরা আদালত খুলে দেওয়ার দাবিতে আন্দোলন করতে শুরু করেন। তবে করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় শারীরিক উপস্থিতিতে আদালত না খুলে বিকল্প পন্থায় কীভাবে মামলা নিষ্পত্তি করা যায়, সেদিকে গুরুত্ব দেয় সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন।
একপর্যায়ে মামলার জট নিরসন ও শুনানির সুবিধা দিতে বিচার বিভাগের সহযোগিতায় এগিয়ে আসে সরকারের নির্বাহী বিভাগ। যার ফলে গত ৯ মে আদালতে ‘তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার অধ্যাদেশ-২০২০’-এর গেজেট প্রকাশ করে সরকার। এরপর সরকার অধ্যাদেশটিকে আইনে পরিণত করে। এই আইনের মাধ্যমে যেকোনও মামলার বিচার, বিচারিক অনুসন্ধান, দরখাস্ত বা আপিল শুনানি, সাক্ষ্যগ্রহণ, যুক্তিতর্ক গ্রহণ, আদেশ বা রায় প্রদানকালে বিভিন্ন পক্ষের ভার্চুয়াল উপস্থিতি নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে আদালতকে তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষমতা প্রদান করা হয়।
ভার্চুয়াল আদালতের বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘সরকারের দীর্ঘদিনের ই-জুডিশিয়ারি চালুর উদ্যোগের একটি অংশ হচ্ছে ভার্চুয়াল আদালত পদ্ধতি। নতুন আইনের ফলে বিশেষ প্রয়োজনে এবং বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ভার্চুয়াল আদালত পদ্ধতি ব্যবহার করা এখন থেকে সম্ভব হবে। এতে করে মামলার জট নিরসনের প্রচেষ্টাও একাধারে চলতে থাকবে।’
কিন্তু ভার্চুয়ালি দেশের সব আদালতে মামলার শুনানি শুরু হলেও নির্দিষ্ট বিষয়ের বাইরে মামলা করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে থাকেন আইনজীবীরা। সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে আগাম জামিনের আবেদনের পথও এ সময়ে বন্ধ রাখা হয়। বিচারিক আদালতেও নিয়মিত মামলা দায়ের, আসামির রিমান্ড শুনানি, আত্মসমর্পণ, সাক্ষ্যগ্রহণের মতো গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম সাময়িকভাবে স্থগিত রাখা হয়।
তাই পুরোপুরিভাবে মামলার শুনানি করতে না পেরে আইনজীবীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে শারীরিক উপস্থিতিতে আদালত খুলে দেওয়ার বিষয়ে ফুলকোর্ট সভা ডাকেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতিদের সঙ্গে প্রধান বিচারপতির বৈঠক শেষে শারীরিক উপস্থিতিতে আদালত খোলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে কোর্ট প্রশাসন। কিন্তু ওই বৈঠকে করোনা মহামারি বিবেচনায় নিয়ে শারীরিক উপস্থিতির পাশাপাশি ভার্চুয়াল পদ্ধতিতেও বিচার পরিচালনার বিষয়ে আলোচনা হয়, যার ধারাবাহিকতায় সুপ্রিম কোর্টে দুই পদ্ধতিতেই বিচারকার্য পরিচালনার বিষয়ে বিজ্ঞপ্তি জারি করে বিচার বিভাগ।
এরপর গত ৫ আগস্ট থেকে দেশের সব নিম্ন আদালতে শারীরিক উপস্থিতিতে বিচারকার্য পরিচালনা শুরু হয়। এর পাশাপাশি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ও চেম্বার আদালত শুধুমাত্র ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে এবং হাইকোর্ট বিভাগের ১৮টি বেঞ্চে শারীরিক উপস্থিতিতে ও ৩৫টি বেঞ্চে ভার্চুয়ালি বিচার পরিচালনা শুরু হয়।
পরে গত ৬ আগস্ট দেশের বিভিন্ন আদালতে ফৌজদারি ও দেওয়ানি মামলা, আবেদন, আপিলসহ এ সংশ্লিষ্ট সব আবেদন দায়েরের তামাদির মেয়াদ আগামী ৩১ আগস্ট পর্যন্ত বৃদ্ধি করেন সুপ্রিম কোর্ট আপিল বিভাগ।
এদিকে, নিয়মিত আদালত না খোলার কারণে পিছিয়ে পড়া পুরনো মামলার মেয়াদ বৃদ্ধি নিয়েও শঙ্কা দেখা দেয়। সে বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. আলী আকবর জানান, করোনা মহামারি বিবেচনায় ফৌজদারি মামলায় যেসব আসামিকে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত জামিন প্রদান করা হয়েছে, বা যেসব মামলায় নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা/স্থিতাবস্থা/স্থগিতাদেশের আদেশ প্রদান করা হয়েছে, সেসব মামলার আদেশের কার্যকারিতা উচ্চ আদালত পূর্ণাঙ্গরূপে খোলার তারিখ পর্যন্ত বর্ধিত থাকবে।
প্রায় পাঁচ মাস ধরে মামলার কার্যক্রম বন্ধ থাকায় পুরনো জট নিরসনের বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘করোনা এখনও পুরোপুরি চলে যায়নি। তবে এর মাঝেও আদালত খুলতে শুরু করেছে। এ সময়ের মধ্যে শারীরিক ও ভার্চুয়াল— এই দুই পদ্ধতিতেই উচ্চ আদালতে বিচারকার্য চলবে। তবে আদালত নিয়মিত খোলার পর মামলার পুরনো জট নিরসনে আমরা পূর্বের গৃহীত উদ্যোগগুলো নিয়ে কাজ শুরু করবো।’