সময়টা দুপুর হওয়ায় আর ভবনের পেছনের দিক বলে এমনিতেই বেশ নির্জনতা ছিল। কিন্তু, রাশেদ যখন এ কথা বলে চুপ হয়ে সামনের আকাশের দিকে তাকালেন, তখন সেই নির্জনতা যেন পাহাড় সমান হয়ে নেমে এলো।
১ ডিসেম্বর ছিল বিশ্ব এইডস দিবস। বিশ্বজুড়ে পালিত হয় দিনটি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, চলতি বছরে নতুন করে এইডস আক্রান্ত হয়েছে ৯১৯ জন। এর মধ্যে বিবাহিত ৫৮৭, অবিবাহিত ১৭৫, তালাকপ্রাপ্ত ১৭, বিধবা ১০ ও চারজন ভিন্নমতের। নতুন আক্রান্তদের মধ্যে মারা গেছেন ১৭০ জন।
রক্ত দিয়ে দুঃসময়ে মানুষের পাশে দাঁড়াতে না পারার কষ্টের কথা বলছিলেন রাশেদ। খেদের সঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমার রক্তের গ্রুপ ও-পজিটিভ, একটু রেয়ার টাইপের। এজন্য উচ্চ মাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় থেকে যখনই কানে এসেছে, কারও ও-পজিটিভ রক্ত দরকার, তখনই সেখানে ছুটে গেছি। মাকে না বলে গেছি। কিন্তু এখন যখন ফেসবুকে রক্ত চেয়ে পোস্ট দেখি, তখন আর নিজেকে সামলাতে পারি না। সব এলোমেলো লাগে। সব ভেঙে ফেলতে ইচ্ছে করে। আমার ভেতরের ভাঙচুর কেউ দেখে না। কাউকে বলতে পারি না, আমি একজন এইডস রোগী। আমি কাউকে রক্ত দিতে পারি না। আমি চাই কিন্তু দিতে পারবো না।’
ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করা রাশেদ নিজের খরচ চালান টিউশনি করে। মাসে আট হাজার টাকা পান, তাই দিয়ে ঢাকায় থেকে লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছেন। ২৪ বছর বয়সী রাশেদের বাড়ি ভোলায়। বাবা মারা গেছেন। গ্রামের বাড়িতে মা আর ছোট দুই বোন রয়েছেন। দুই ভাই তিন বোনের মধ্যে সবার ছোট রাশেদ।
‘২০১৬ সালে একবার অসুস্থ হলে চিকিৎসকরা এইচআইভি টেস্ট করান। রিপোর্ট নেগেটিভ এলো। পরের বছরের ৭ মার্চ আবার শরীর খারাপ হয়। সেবার পজিটিভ আসে। ১৩ মার্চ আমার অনার্স তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষা শুরু হয়। কাউকে কিছু না বলে পরীক্ষা দিই, সঙ্গে চিকিৎসা চলতে থাকে। চিকিৎসা শুরুর পর থেকে ওষুধ অ্যাডজাস্ট হতে সময় লাগছিল। আমি পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছি। কী ভীষণ দিন কাটিয়েছি! এখনও একা একা ভাবি। মানুষের অসুখ হলে বাড়িতে বলে, বন্ধুদের বলে–স্বজনরা পাশে থাকে তখন। অথচ আমার এমন অসুখ কাউকে বলার মতোই না। এখন আমার চিকিৎসা চলছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে’—বলেন রাশেদ।
আপনি কীভাবে এইচআইভি পজিটিভ হলেন–জানতে চাইলে বলেন, ‘আমি জানি না।’
এখন সুস্থ আছেন রাশেদ। তিনি জানান, নিয়মিত ওষুধ খাচ্ছেন, দরকার হলে চিকিৎসকের কাছে যাচ্ছেন।
রাশেদ জানান, তার এ অবস্থার কথা পরিবারের কেউ জানে না। কেবল কাছের দুজন বন্ধু জানে। বাড়ি থেকে এখন বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে, বিশেষ করে মা। তার বয়স হয়েছে। তিনি ছোট ছেলের বউ দেখতে চান। বিয়ের জন্য চাপের কারণে এখন বাড়ি যাওয়া বাদ দিয়েছেন। তবে এ নিয়ে রাশেদের আক্ষেপ নেই। আক্ষেপ কেবল রক্ত না দিতে পারার জন্য।
‘ছোটবেলা থেকেই মানুষের জন্য কিছু করার ইচ্ছে ছিল। আর তো কিছু করার সাধ্য ছিল না, তাই কারও রক্ত লাগবে শুনলে ছুটে যেতাম। আমার রক্ত দিতে চাওয়ার আগ্রহের কথা অনেকেই জানেন আগে থেকে। তারা এখনও রক্ত দরকার হলে আমাকে বলেন। তখন তাদের বলি, আমি কিছুদিন আগেই রক্ত দিয়েছি। সবাইকে মিথ্যা বলি।’ রক্ত দিতে না পারার আফসোস দিয়েই কথা শেষ করেন রাশেদ।