ডোনারের অভাবে কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট হয় না নারীদের

কিডনি রোগীদের হালচাল দ্বিতীয় পর্ব

ফরিদা আখতার (৫৫) রাজধানীর বারডেম হাসপাতালে নিয়মিত ডায়ালাইসিস করান। তার স্বামী ও দুই সন্তান রয়েছে। পরিবারের সদস্যদের কারো কাছ থেকে কিডনি ট্রান্সপ্লান্টের পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসক। কিন্তু নানা কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না।

ফরিদা আখতার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ট্রান্সপ্লান্ট করতে চাইলে পরিবারের কারও কিডনি নিতে হবে।’ আপনি পরিবারের কারো কাছ থেকে কিডনি নিতে চান কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী তো নিজেই ডায়াবেটিসের রোগী। দুই সন্তানের বয়স অল্প। কিডনি দিতে চাইলেও কার কাছ থেকে নেবো, বলেন?’

শুধু ফরিদা আখতার নন, সারাদেশে যত কিডনি রোগে আক্রান্ত নারী আছেন, তাদের বেশিরভাগই কিডনি রোগে ভুগেই মারা যান। দরকার হলেও তাদের কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করা সম্ভব হয় না।

বাংলাদেশ রেনাল অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যানুযায়ী, বিশ্বের ৬৫ থেকে ৭৪ বছর বয়সের প্রতি চারজনে একজন নারী কিডনি রোগে আক্রান্ত। দেশে নানা ধরনের কিডনি রোগে আক্রান্ত নারীর সংখ্যা এক কোটির বেশি বলে ধারণা করা হয়। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, কিডনি ট্রান্সপ্লান্টের (প্রতিস্থাপন) প্রশ্নে নারীদের ক্ষেত্রে ডোনার পাওয়া যায় না বললেই চলে। এর পেছনে অসচেতনতাকেই দায়ী করছেন চিকিৎসকরা।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) অধ্যাপক ডা. মো. রফিকুল আলম বলেন, ‘সবচেয়ে বেশি মা সন্তানকে কিডনি দেন। এ হারটা সবচেয়ে বেশি। এরপর স্ত্রী স্বামীকে, বোন ভাইকে কিডনি দেন। কিন্তু আফসোসের বিষয় হচ্ছে কোনও নারীকে তার স্বামী কিডনি দিচ্ছেন, এমনটি আমরা দেখতে পাইনা।’ তবে তিনি বলেন, ‘আমার দেখা একজন স্বামী তার স্ত্রীকে কিডনি দিয়েছেন, কিন্তু তিনি তার নাম কিছুতেই প্রকাশ করতে চাননি।’

বাংলাদেশ রেনাল অ্যাসোসিয়েশন বলছে, নারীর মৃত্যুর অষ্টম কারণ কিডনি রোগ। প্রতিবছর বিশ্বে ছয় লাখ নারী কিডনি রোগে মারা যান।

সংস্থাটি বলছে, সন্তান জন্মদানের সময় নারীর কিডনি বেশি ঝুঁকিতে পড়ে। তবে সন্তান জন্মদানের সময় মাতৃমৃত্যুর কারণ কিডনি রোগ নয়। এ সময় উচ্চ রক্তচাপ বেড়ে যাওয়ায় নারীর কিডনি রোগের ঝুঁকি বাড়ে। প্রতি দশজন নারীর মধ্যে নয়জনের মূত্রনালির প্রদাহজনিত সমস্যা রয়েছে।

বিশ্বব্যাপী নারীর কিডনি রোগ সম্পর্কে সচেতনতার লক্ষ্যে ২০১৮ সালের কিডনি দিবসের প্রতিপাদ্য রাখা হয় ‘নারী এবং কিডনি রোগ’।
চিকিৎসকরা বলছেন, নারীর নিজের রোগ সম্পর্কে অসচেতনতা, তার অসুস্থতা সম্পর্কে পরিবারের সদস্যদের অনীহা, পুরুষের তুলনায় দীর্ঘজীবন বেঁচে থাকার কারণে হয়তো নারী এই রোগে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। এক্ষেত্রে যাদের পরিবারে কিডনি রোগী আছে, যারা ধূমপায়ী এবং যাদের স্থূলতা বেশি, তাদের বেশি সতর্ক থাকার পরামর্শ চিকিৎসকদের।

বিএসএমএমইউ’র অধ্যাপক ডা. আছিয়া খানম বলেন, ‘রোগের ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের কিডনি রোগ সমান সমান। একিউট কিডনি ফেইলিউর নিয়ে এখন আমাদের হাসপাতালে নারী ও পুরুষ উভয় রোগীই আসছে। বরং প্রেগন্যান্সিজনিত কিডনি ফেইলিউরগুলো নারীদের বেশি হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘ট্রান্সপ্লান্টের ক্ষেত্রে দেখা যায়, নারীরা ডোনার হিসেবে বেশি। কারণ, আমাদের দেশে রিলেটেড ট্রান্সপ্লান্ট বেশি হয়, মা-বাবা, ভাই-বোন, মামা-চাচা-খালা-ফুফু, এরা দেয়। তবে এর মধ্যে যতগুলো ট্রান্সপ্লান্ট হয় এর মধ্যে ৭০ ভাগ দেন মা, মা সন্তানকে দিচ্ছেন। নারীদের ট্রান্সপ্লান্টের হার কম। হয়তো বা স্পেশাল কারণে হতে পারে। বা তিনি নিজেই স্যাক্রিফাইস করছেন। কেউ এগিয়ে আসছে না দিতে।’

ডা. আছিয়া খানম বলেন, ‘নারী ডোনার হিসেবে বেশি দিচ্ছেন। মা, খালা, চাচি, কয়েকজন স্ত্রীও কিডনি দিয়েছেন স্বামীকে। এই হিসাব করলে নারী ডোনার বেশি, কিন্তু গ্রহীতা খুবই কম। হয়তো বা সোশ্যাল কারণে হতে পারে, নারীকে কেউ কিডনি দিতে চান না!’

আরও পড়ুন...

পর্ব-১: ডায়ালাইসিসের সুবিধা পান মাত্র এক-চতুর্থাংশ কিডনি রোগী