মা ডাকেশ্বরী রানীর ছেলের এই অতিরিক্ত কারাবাসের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি দাবি করেছেন।
ডাকেশ্বরী রানী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার ছেলের ছয় মাসের সাজা হয়। ছয় মাসের সাজা খাটার পরও পাঁচ মাস কারাগারে।’
তিনি বলেন, “কোথাও কোনও খোঁজ-খবর পাই না আমার ছেলের। কোর্টে আসলে স্টাফরা বলেন, ‘আপনার ছেলে কারাগারে আছে। আমরা মামলার কাগজপত্র কারাগারে পাঠিয়ে দিয়েছি।’ এরপর কারাগারে গেলে কর্তৃপক্ষ বলে, ‘আদালত থেকে কোনও কাগজ আসে নাই।’ এভাবে করে আজ পাঁচ মাস ধরে আমি কোর্টের বারান্দায় ঘুরছি ছেলের মুক্তির জন্য।”
অসহায় এই মা বলেন, “পরে জানতে পারি আগের এক পেশকার এমদাদ ছিলেন এই কোর্টে। তার কাছে গেলে তিনি বলেন, ‘আমার কাছে কোনও কাগজ নাই। আমি ওই কোর্টে সব রেখে আসছি।’ পরে আমি উকিল ধরছি। আমার উকিল শুনানি করছে। সাজার খাটার পরও পাঁচ মাস আমার ছেলের বিনা বিচারে জেলখানায়। ওর জীবনটা শেষ করে দিয়েছে। আমি এর সুস্থ বিচার চাই।”
তেজগাঁও থানায় দায়ের মামলায় ২০১৫ সালের ১০ মার্চ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে ১৯(১) ও ৯(ক) ধারায় ঢাকা মহানগর হাকিম আদালত আসামি শাকিলের অনুপস্থিতে ছয় মাসের কারাদণ্ড ও এক হাজার টাকা অর্থদণ্ড অনাদায়ে ১৫ দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড ঘোষণা করেন। এরপর শাকিলের বিরুদ্ধে সাজা পরোয়ানা ইস্যু করেন বিচারক।
মামলার অভিযোগ থেকে জানা যায়, ২০১০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি তেজগাঁও থানার পশ্চিম নাখাল পাড়া এলাকা থেকে ১০ পিস ইয়াবা ট্যাবলেটসহ শাকিলকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে ওই ঘটনায় এসআই শাহ আলাম বাদী হয়ে মামলা (নং ৭৭) দায়ের করেন। ২০১১ সালের ৩১ জানুয়ারি একই থানার এসআই আব্দুল জলিল অভিযোগপত্র দেন। এরপর আসামির বিরুদ্ধে একই বছরের ১৫ মার্চ অভিযোগ গঠন করেন আদালত। পরে ২০১৩ সালের ২১ এপ্রিল আসামি শাকিল জামিন গিয়ে পলাতক থাকেন। মামলাটির দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে বিচার চলাকালে তিনজন সাক্ষীর জবানবন্দি নেন আদালত। এরপর ২০১৫ সালের ১০ মার্চ তৎকালীন বিচারক শাহরিয়ার মাহমুদ আদনান আসামি শাকিলকে দোষী সাব্যস্ত করে কারাদণ্ড দেন।
গত বছরের ৬ এপ্রিল সাজা পরোয়ানা মূলে গ্রেফতার করে তেজগাঁও থানা পুলিশ শাকিলকে ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করে। বিচারক তাকে কাস্টডি ওয়ারেন্ট দিয়ে জেলহাজতে পাঠান।
তিনি বলেন, ‘গত ২৫ ফেব্রুয়ারিতে আমরা বিচারিক আদালতে দরখাস্ত দিয়ে শুনানি করি। আদালত নথি তলব করেন। পরে দেখা যায়, নথিতে আসামির সাজা পরোয়ানা ইস্যু করা হয়নি। নথিতে কোনও উপনথি পর্যন্ত নাই। নথিতে কোনও আদেশও নাই। পরে আদালত ৪ মার্চ আসামিকে আদালতে হাজির করার আদেশ দেন। এরপর বিচারক তাকে মুক্তি দেওয়ার জন্য জেল কর্তৃপক্ষকে আদেশ দিলেন।’
আইনজীবী কমল বলেন, ‘আদালতের তৎকালীন পেশকার এমদাদ আসামি শাকিলের মামলার নথিতে সাজা পরোয়ানা যুক্ত করেন নাই। শুধু কাস্টডি ওয়ারেন্ট ইস্যু করে আসামিকে কারাগারে পাঠান। মূলত একজন মানুষের দায়িত্বে অবহেলার কারণে অন্যজনকে বিনা কারণে পাঁচ মাস বেশি সাজা খাটতে হলো। এর সুস্থ বিচার হওয়া উচিত।’
বিচারক মোর্শেদ আল মামুন ভূইয়া তার আদেশে বলেন, ‘যেহেতু গত বছরের ৬ এপ্রিল থেকে আসামি কারাগারে আছেন। আইন অনুযায়ী মূল নথিতে সাজা পরোয়ানা ইস্যু করা হয়নি। কিন্তু আসামির হাজতবাস কারাদণ্ডের চেয়েও বেশি হওয়ায় মুক্তি দেওয়া হোক।’
তৎকালীন পেশকার এমদাদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আসামির সাজা পরোয়ানা ইস্যু করা হয় নাই, এটা আমার ভুলের কারণে হলেও কারা কর্তৃপক্ষও কিন্তু এতদিন আসামি কারাগারে আছে— এ বিষয়ে কোনও তথ্য দেয় নাই আদালতে। কারা কর্তৃপক্ষের তো উচিত ছিল একটা প্রতিবেদন চাওয়ার। তারা তাও করে নাই।’
তিনি বলেন, ‘অনেক আগেই ওই আদালত থেকে অন্য আদালতে বদলি হয়ে আসছি। বিষয়টিতো এখন আমার কাছে নাই।’
ঢাকা মহানগরের পাবলিক প্রসিকিউটর আব্দুল্লাহ আবু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘একজন আসামির সাজা খাটার পরও কারাগারে থাকাটা খুবই দুঃখজনক। এরকম ঘটনা যাতে আর না ঘটে, আদালতের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।’
আইনজীবী সৈয়দ মো. আসলাম বাংলা ট্রিবিউন বলেন, ‘একজন আসামি গ্রেফতার হয়ে বিচারিক আদালতে আসলে আইন অনুযায়ী তাকে সাজা পরোয়ানা ইস্যু করে কারাগারে পাঠানো হয়। সাজার মেয়াদ শেষ হলে কারা কর্তৃপক্ষ মুক্তি দেবে। এখানে আইনের ব্যত্যয় ঘটেছে।’