কেবল মানুষের জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করাই খাদ্য নিরাপত্তা নয়। মানুষ যেসব প্রাণ-এর ওপর খাদ্যের জন্য নির্ভর করে, সেসব প্রাণের খাবার নিরাপদ করাও খাদ্য নিরাপত্তার অংশ বলে মন্তব্য করছেন প্রাণ ও প্রতিবেশ গবেষকরা। তারা বলছেন, মানুষের খাবার নিরাপদ করতে গিয়ে আমরা প্রকৃতির অন্য যেসব প্রাণ রয়েছে, তাদের অনিরাপদ করে তুলছি। মানুষের চেয়ে তাদের ‘ফুড ক্রাইসিসটা’ বেশি।
দেশের বাড়তি খাদ্য উৎপাদনে বড় অর্জন আনতে গিয়ে বেড়েছে রাসায়নিক সারের প্রয়োগ। আর মাটির ওপর নির্বিচারে রাসায়নিক প্রয়োগের ফলে খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু খাদ্যের গুণগতমান নষ্ট হয়েছে। প্রাণ বৈচিত্র্য হারিয়ে গেছে। জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের প্রতিবেদন অনুযায়ী, স্বাস্থ্য অধিদফতরের স্যানিটারি ইন্সপেক্টররা ২০১৫ সালে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ছয় হাজার ৩৬০টি খাদ্যপণ্যের নমুনা সংগ্রহ করেন। তারা সেগুলো মহাখালীর জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের (আইপিএস) ফুড টেস্টিং ল্যাবরেটরিতে পাঠান। সংগৃহীত ওই নমুনার মধ্যে এক হাজার ৯৭৮টিতে, অর্থাৎ ৩১ দশমিক ১০ শতাংশ খাদ্যপণ্যে ভেজাল পাওয়া যায়।
প্রাণ ও প্রতিবেশ গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, ‘যেখানে খাদ্য উৎপাদিত হয়, যেটা কৃষকরা সরাসরি উৎপাদন করেন, সেখানে তাদের বাধ্য করা হচ্ছে। সেচ, রাসায়নিক, কীটনাশক ব্যবহার করে যে কৃষি পদ্ধতি তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, তার ফলে খাদ্যের উৎস নিরাপদ থাকছে না। এরপর খাদ্যটি উৎস স্থান থেকে পরিবহন ও গুদামজাতের সময় যে রাসায়নিক মেশানো হয়, সেটির মনিটরিং জরুরি। শস্য ছাড়াও বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত মাছ ও মূল আমিষের উৎস ডিম-মুরগিও বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। এর কারণ রাসায়নিকের ব্যবহার। পোল্ট্রিতে খাওয়ানো হচ্ছে ট্যানারির বর্জ্য। এই বর্জ্য মাছের খামারেও ব্যবহার হচ্ছে। আবার পোল্ট্রি মুরগির বর্জ্য জমিতে ও মাছের খামারে ব্যবহৃত হচ্ছে।’
কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদাহরণ টেনে পাভেল পার্থ আরও বলেন, ‘এসবের কারণে শাক-সবজিতে ব্যাকটেরিয়া পাওয়া যাচ্ছে, যা কলেরা ও ডায়রিয়ার জীবানু নিয়ে ঘুরছে। এরমধ্যে শশা ও কাঁচা মরিচ বিপজ্জনক। কারণ, এগুলো মানুষ খুব বেশি ধুয়ে খায় না। কাঁচা খায়।’
পাভেল পার্থ মনে করেন, ‘খাবারের উৎসগুলোতেই যখন খাবার নিরাপদ নয়, তখন সেটা ভয়াবহ। মানুষের জন্য খাদ্য নিরাপদ করতে গিয়ে প্রকৃতির অন্যান্য যে প্রাণ রয়েছে, তারা হয়ে উঠছে অনিরাপদ। ফুড ক্রাইসিসটা তাদের বেশি হচ্ছে। প্রকৃতিতে চরম খাদ্য সংকট দেখা যাচ্ছে। শুধু মানুষের খাবার নিরাপদ করার মধ্য দিয়ে খাদ্যের নিরাপত্তা সম্ভব না। শামুক, মাছ, পাখির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক আছে। পুরো প্রতিবেশ, খাদ্য শৃঙ্খলের কথা মাথায় রাখতে হবে। আমাদের পরিবেশে যে দখল ও দূষণ ঘটছে, এর কারণে পুরো খাদ্য অনিরাপদ হয়ে উঠছে। প্রকৃতিকে হতে হবে মুক্ত।’
প্রাকৃতিক কৃষিজাত পণ্য নাগরিকদের কাছে নিয়ে আসার কাজ করছেন দেলোয়ার জাহান। তিনি বলেন, ‘বাণিজ্যিক কৃষি উৎপাদনের সময় হরমোন ও রাসায়নিক দেওয়ায় বিভিন্ন দূষণ হয়। আমরা যে খাদ্য উৎাদন করি, রাসায়নিক দেওয়া হয় না। বিষ কিংবা হরমোন দেওয়া হয় না। তবে কেবল নিরাপদ খাদ্য মানে রাসায়নিক দেওয়া না দেওয়া নয়। কোন মাটিতে কী পদ্ধতিতে উৎপাদিত হচ্ছে, সেটা বিবেচনা করতে হবে। শস্য উৎপাদনে রাসায়নিক ব্যবহার হচ্ছে, সেই পানি পুকুরে ও নদীতে মিশছে। সবটা মিলে বিষ ছড়াচ্ছে। এরমধ্যে কেবল বাজার ব্যবস্থা মনিটর করে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার কথা ভাবা সম্ভব না। এর জন্য খাদ্য উপাদনের উৎস এবং কিসের সহায়তায় এটা সম্পন্ন হচ্ছে, তাদেরও নিরাপদ রাখার কৌশল বের করতে হবে।