উজানে ‘মেগা ড্যামের’ ধাক্কা সামলাতে দিল্লি-ঢাকা-থিম্পুকে জোট বাঁধার ডাক

ভারত ও বাংলাদেশে যে নদের নাম ব্রহ্মপুত্র, উৎসস্থল তিব্বতে তাকে ডাকা হয় ইয়ারলং সাংপো নামে। বিশ্বের দীর্ঘতম ও বৃহত্তম নদ-নদীগুলোর মধ্যে এটি একটি। গত বছরের বড়দিনে (২৫ ডিসেম্বর) এই নদের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বাঁকে একটি ‘মেগা ড্যাম’ এবং বিশ্বের সবচেয়ে বড় জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরির ঘোষণা দিয়েছে চীন।

ইয়ারলং সাংপো যেখানে টানা কয়েকশো মাইল পূর্ববাহিনী হয়ে প্রবাহিত হওয়ার পর আচমকা ৩ হাজার মিটার গভীর গিরিখাতের মধ্যে দিয়ে দুম করে গোঁত্তা খেয়ে দক্ষিণমুখী হয়েছে, সেই ‘গ্রেট বেন্ড’ নামে পরিচিত বাঁকেই নির্মিত হবে এই বাঁধ, জলাধার আর বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র।

তিব্বতের মেডগ কাউন্টিতে অবস্থিত বলে এই কেন্দ্রটিকে বলা হচ্ছে, ‘মেডগ হাইড্রোপাওয়ার স্টেশন’, আর প্রস্তাবিত ড্যামটি পরিচিতি পেয়েছে ‘গ্রেট বেন্ড ড্যাম’ নামে। তবে এই সুবিশাল প্রকল্পের পরিবেশগত, ইকোলজিকাল ও প্রাকৃতিক প্রভাব কী হতে পারে, তা ভেবে ইতিমধ্যেই সারা দুনিয়ার বিশেষজ্ঞদের কপালে ভাঁজ পড়েছে।

সেমিনারে (বাঁদিক থেকে) সব্যসাচী দত্ত, তাপির গাও, বার্টিল লিন্টনার

সম্প্রতি আসামের রাজধানী গুয়াহাটিতে একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারেও বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানী, গবেষক, কূটনীতিক, নদী বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবিদরা ঠিক এই বিষয়টি নিয়েই দিনভর আলোচনা করলেন। আর তাদের সর্বসম্মত রায় ছিল খুব সহজ– এই মেগা ড্যামের অভিঘাত যাই হোক, সেটা সামলাতে ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার ভাঁটির দেশগুলোকে একযোগেই কাজ করতে হবে!

তিব্বত থেকে দক্ষিণে বাঁক নিয়ে ভারতের অরুণাচল প্রদেশে প্রবেশ করার পর ব্রহ্মপুত্র বয়ে গেছে আসামের বুক চিরে। নদটি উত্তরের জেলা কুড়িগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। যা পরে জামালপুর জেলার বাহাদুরাবাদের কাছে যমুনা ও পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নামে দুভাগে বিভক্ত হয়। এরপর যমুনা নদীর দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হয়ে গোয়ালন্দের পদ্মার সঙ্গে মিলিত হয় এবং অপর ধারাটি পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নামে দক্ষিণ-পূর্বমূখী হয়ে ভৈরববাজারে মেঘনার সঙ্গে মিশেছে। ফলে ভারত ও বাংলাদেশই হল ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার ভাঁটির দেশ, সঙ্গে ভুটানেরও একটা বড় অংশ এই অববাহিকার ভেতরেই পড়ে।
 
বিশেষজ্ঞরা এ কারণেই বলছেন, চীনের মেগা ড্যামের ধাক্কা সামলাতে প্রযুক্তিগত, বৈজ্ঞানিক ও কূটনৈতিক ক্ষেত্রে ভারত, ভুটান ও বাংলাদেশের পারস্পরিক সহযোগিতা ও সমন্বয় খুব জরুরি।

এক্ষেত্রে মেকং নদীর দৃষ্টান্ত একটি দারুণ তুলনা হতে পারে, সেমিনারে বলছিলেন ভিয়েতনাম ন্যাশনাল মেকং কমিটির প্রধান ত্রুয়ং হং তিয়েন। মেকং-এর সঙ্গে ব্রহ্মপুত্রর অনেক মিলও আছে।

মেকং নদী

আসলে মেকং নদীর উৎপত্তিও তিব্বত মালভূমিতে, তারপর চীন থেকে এই সুদীর্ঘ নদী প্রবাহিত হয়েছে মিয়ানমার, লাওস, থাইল্যান্ড, কাম্বোডিয়া ও ভিয়েতনামের মতো আরও পাঁচটি দেশের ভেতর দিয়ে। ত্রুয়ং হং তিয়েন জানালেন, গ্রেটার মেকং সাবরিজিওনে এই দেশগুলোর মধ্যে যে অসাধারণ সহযোগিতার ইতিহাস আছে, সেই একই মডেল অনুসরণ করলে ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার ভাঁটির দেশগুলোও নিঃসন্দেহে উপকৃত হবে।
 
উত্তর-পূর্ব ভারতের সুপরিচিত থিংকট্যাংক ‘এশিয়ান কনফ্লুয়েন্স’ আয়োজন করেছিল এই সেমিনারের। ওই প্রতিষ্ঠানের প্রধান সব্যসাচী দত্ত বলেন, আসলে মেগা ড্যামের কারণে যে ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে তার মোকাবিলায় ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় যথেষ্ঠ তথ্যের অভাব আছে, তেমন কোনও মডেলিং-ও নেই।

দেশে দেশে ভিন্ন নামে একই নদী

ভারত, বাংলাদেশ, ভুটানের মতো ‘লোয়ার রাইপেরিয়ান’ বা ভাঁটির দেশগুলো যদি এক্ষেত্রে নিজেদের মধ্যে তথ্য বিনিময় করে এবং এই ইস্যুগুলো প্রযুক্তি, বিজ্ঞান, আর্থসামাজিক বা পরিবেশগত ক্ষেত্রে যৌথভাবে অ্যাড্রেস করে তাহলে সমাধানের পথ বেরোতে পারে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
 
বিখ্যাত ফরাসি তিব্বত বিশেষজ্ঞ (টিবেটোলজিস্ট) ও লেখক ক্লড অর্পি সেমিনারে অংশ নিয়ে জানান, মেডগ হাইড্রোপাওয়ার স্টেশনের মাধ্যমে অন্তত ৬০০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত উতপাদন করে চীন শুধু বিশ্বের পাওয়ার জায়ান্ট হয়ে উঠতে চাইছে তাই নয়, তারা এই প্রকল্পের মাধ্যমে ইয়েলো রিভারে (পীত নদী) টানেলের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ জল সরিয়ে নেওয়ারও পরিকল্পনা করছে।

ক্লড অর্পি

ফলে এই মেগা ড্যামের কারণে ব্রহ্মপুত্রের নিম্ন অববাহিকায় প্রবাহ শুকিয়ে যাওয়ার প্রবল আশঙ্কা আছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
 
ঠিক একই আশঙ্কার প্রতিধ্বনি করে ভারতের অরুণাচল থেকে নির্বাচিত পার্লামেন্টারিয়ান তাপির গাও বলেন, এমনিতেই প্রমত্ত ব্রহ্মপুত্র (অরুণাচলে যার নাম সিয়াং) এখন প্রায়শই শুকিয়ে যাচ্ছে, নদীর বুকে চরও পড়ছে। চীনের এই মেগা ড্যাম তৈরি হলে শুধু অরুণাচল নয়, ভাঁটির আসাম ও বাংলাদেশও শুকিয়ে যাবে, নদীতে মাছ হারিয়ে যাবে, নদীর তীরে বসবাসকারী লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন ও জীবিকায় বিপর্যয় নেমে আসবে বলে তিনি জানান।
 
এই প্রেক্ষাপটেই অন্য এক ধরনের বিপদের সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেন ভুটানের ইভ্যালুয়েশন অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য তথা আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পরিবেশবিদ ছিম্মি দোর্জি। তিনি বলেন, আসলে এই মেগা ড্যাম থেকে দুরকম বিপর্যয়ের আশঙ্কা আছে। মেডগের জলাধার থেকে যদি ইচ্ছাকৃতভাবে কিংবা ভূমিকম্প বা অন্য কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে অনিচ্ছাকৃতভাবে জল ছাড়া হয় তাহলে ভাঁটির পুরো এলাকা বিধ্বংসী বন্যায় প্লাবিত হবে – যে ধরনের ঘটনা আগেও ঘটেছে।

ছিম্মি দোর্জি

আবার অন্য দিকে শীতে বা শুষ্ক মৌশুমে যখন ব্রহ্মপুত্রে জল এমনিতেই কম থাকে, তখন মেগা ড্যামে বিপুল পরিমাণ অতিরিক্ত জল টেনে নেওয়ার কারণে নিম্ন অববাহিকায় জলের প্রবাহ শুকিয়ে যাবে অবধারিতভাবে। আসাম, অরুণাচল, বাংলাদেশের মানুষের পানীয় জলে টান পড়বে, শীতের ফসল সেচের জল পাবে না বলেও পূর্বাভাস করেন ছিম্মি দোর্জি। 

প্রসঙ্গত, একইভাবে বাংলাদেশের আরেক অন্যতম বড় নদী তিস্তার উজানে একাধিক বাঁধ, ব্যারাজ ও জলবিদ্যুৎসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করেছে ভারত। যার ফলে বাংলাদেশে তিস্তা নদীর পানির প্রবাহ কমেছে। এই অবকাঠামোগুলো তিস্তার উজানে পানির চাহিদা পূরণ করলেও ভাটিতে বাংলাদেশ অংশে তিস্তা নদীতে পানির প্রাপ্যতাতে ভয়াবহভাবে প্রভাব ফেলেছে। এমনকি এরফলে উত্তরবঙ্গের পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার আশঙ্কাও করেছেন বিজ্ঞানীরা। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে দীর্ঘদিন এই পানির ন্যায্য হিস্যার দাবি তোলা হলেও তা কূটনৈতিক হিসাব-নিকাশের ফাঁদেই আটকে আছে।

তিব্বতের সেই ‘গ্রেট বেন্ড’

ভারতের ব্রহ্মপুত্র বোর্ডের চেয়ারম্যান রণবীর সিং আলোচনা চক্রে জানান, গোটা দেশে এই মুহূর্তে একমাত্র ‘ওয়াটার সারপ্লাস’ রিভার বেসিন হলো ব্রহ্মপুত্র– যার মানে একমাত্র সেখানেই জলের পরিমাণ উদ্বৃত্ত আছে। কিন্তু চীনের এই নতুন উচ্চাভিলাষী ও পরিবেশগতভাবে বিপজ্জনক প্রকল্পের ফলে সেই ব্রহ্মপুত্র রিভার বেসিনও শুকিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে– যা এক কথায় অকল্পনীয়!
 
নদী বিশেষজ্ঞ নীরজ সিং মানহাস মনে করিয়ে দেন, তিব্বতের যে বাঁকে গ্রেট বেন্ড ড্যামটি তৈরি করা হচ্ছে, সেখানে এলিভেশন (উচ্চতা) প্রায় ৪৫০০ মিটার, আর নদীর বাঁকের গ্র্যাডিয়েন্ট বা গিরিখাতের ঢালও অত্যন্ত খাড়াই, ফলে সেখানে থেকে জল ছাড়া হলে তা ভাঁটির এলাকা ভাসিয়ে দেবে তীব্র বেগে। আবার শীতে সেই একই বাঁধ তৈরি করবে খরার পরিস্থিতি।

বার্টিল লিন্টনার

সেমিনারে সমাপনী বক্তৃতা দেন সুইডিশ সাংবাদিক ও দীর্ঘদিন থাইল্যান্ড প্রবাসী বার্টিল লিন্টনার।
 
তিনি বলেন, আসলে এই সমস্যাটির চরিত্র এত জটিল এবং বিপর্যয়ের সম্ভাবনা এতটাই প্রবল যে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও যৌথ বৈজ্ঞানিক গবেষণা ছাড়া ব্রহ্মপুত্র অববাহিকাকে বাঁচানো সম্ভব নয়। মেকং অববাহিকার দেশগুলো ঠিক এই কাজটাই সফলভাবে করেছে, এখন একই দায়িত্ব ব্রহ্মপুত্র বেসিনের দেশগুলোরও।
 
তবে এই মুহূর্তে ভারত, বাংলাদেশ ও চীনের পারস্পরিক সম্পর্কে‍ যে ধরনের জটিলতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে তাতে কাজটা যে বেশ দুরূহ, তা বলার অপেক্ষা রাখে না!