স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস আজ শুক্রবার (১৪ ফেব্রুয়ারি)। ১৯৮৩ সালের এই দিনে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সামরিক শাসনের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে সংগঠিত ছাত্র আন্দোলনে পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালালে জাফর, কাঞ্চন, দীপালী সাহাসহ ১০ জন নিহত হন। সামরিক শাসকের বিরুদ্ধে এই ছাত্র আন্দোলন কালক্রমে রূপ নেয় স্বৈরাচারবিরোধী গণ-আন্দোলনে, যার সমাপ্তি ঘটে নব্বইয়ে এরশাদ সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে।
১৯৮২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর একটি নতুন শিক্ষানীতি প্রস্তাব করেছিল জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সরকার। তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ড. মজিদ খান শিক্ষানীতি ঘোষণার আগেই সে বছর ১৭ সেপ্টেম্বর ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন শুরু করে ছাত্র সংগঠনগুলো। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ঐক্যবদ্ধ ছাত্র আন্দোলনের প্ল্যাটফরম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে সচিবালয়ে স্মারকলিপি দেওয়ার কর্মসূচি ঘোষণা করে।
ওই কর্মসূচির আগে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ সমাবেশে গুলি চালায় পুলিশ। নিহত হন জাফর, জয়নাল, দীপালী ও কাঞ্চনসহ ১০ জন। আহত হন আরও অনেকে। তুমুল আন্দোলনের মুখে পরবর্তী সময়ে বাতিল হয় সেই শিক্ষানীতি। সেদিন থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালন করা হয়। এর কিছুদিন পর সরকার একটি ঘোষণা দিয়ে মজিদ খানের শিক্ষানীতি স্থগিত করে।
চব্বিশের ছাত্র বিপ্লবের পর প্রথমবারের মতো দিবসটি পালিত হতে যাচ্ছে। দিনটি উপলক্ষে বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে আলাপকালে সে সময়ের স্মৃতিচারণ করেছেন তৎকালীন ছাত্র নেতারা। পাশাপাশি চব্বিশের বিপ্লবের তাৎপর্যও তুলে ধরেন তারা। বর্তমান ছাত্র নেতারাও ইতিহাসের পরিক্রমায় ছাত্র আন্দোলনগুলোর গুরুত্বের ওপর জোর দেওয়ার মত দিয়েছেন।
সাবেক ছাত্রনেতা মোশতাক হোসেন নব্বই ও চব্বিশের প্রেক্ষাপটের ভিন্নতা দেখিয়ে বলেন, ৮৩ সালের এইদিনে ছাত্র বিস্ফোরণ ঘটেছিল, সেটাকেও ছাত্র অভ্যুত্থান বলা চলে, হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী নেমে এসেছিল। এটার জন্য সামরিক শাসন আসার পর থেকেই, ৮২ সাল থেকে আমরা কাজ করছিলাম। ৯ বছরের ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ পরবর্তীতে ছাত্র ঐক্য ধারাবাহিকভাবে কর্মসূচি করেছি। ৯০ এর রাজনৈতিক দল ও সাধারণ জনগণ সম্পৃক্ত হয়ে জয়লাভ করেছে। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের আগেও আন্দোলন সংগ্রাম হয়েছে বিশেষ করে চৌদ্দোর ভুয়া নির্বাচনের পর। তবে ছাত্রসমাজ প্রকাশ্যে এসে কাজ করতে পারে নাই। আমরা প্রকাশ্যে সংঘটিত হতে পেরেছি, আমাদের জেল হয়েছে, হুলিয়া ছিল, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করেছে। কিন্তু আমাদের কার্যক্রম ছিল প্রকাশ্যে। শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদ এমনই ছিল ছাত্ররা প্রকাশ্যে একত্রিত হওয়ার সুযোগ পেতো না, এমনকি যেগুলো নির্দলীয় আন্দোলন সেগুলোও নৃশংসভাবে দমন করেছে। ফলে বাধ্য হয়েই তারা গোপনে সংঘটিত হয়েছে, এমনকি শাসক দলের অভ্যন্তরেও গোপনে সংগঠিত হয়েছে। শেখ হাসিনাও এতে রক্ষা পায়নি।
ছাত্র সংগঠনগুলোর প্রকাশ্য রাজনৈতিক কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়া চব্বিশের অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে বিপ্লবের শক্তিগুলোর মত পার্থক্য প্রকট হয়েছে বলে মনে করেন সাবেক এই ছাত্রনেতা। তিনি বলেন, ৯ বছরের আন্দোলনে আমরা কী কী চাই, প্রকাশ্য ছিল সেগুলো। তবে এবার ছাত্রদের মধ্যে নানারকম মত ছিল। অভ্যুত্থান সফল হওয়ার পর যার যার মত তার তার মতো করে প্রকাশ করছে। তাদের কাঠামোগত পার্থক্য না হলেও, রাজনৈতিক পার্থক্য নিয়ে দেখা যাচ্ছে সমস্যা হচ্ছে। কেউ ইসলাম পছন্দ করে, কেউ সেকুলার পছন্দ করে, কেউ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার স্বপক্ষে।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবসের গুরুত্ব সম্পর্কে সাবেক ছাত্রনেতা বাকি বিল্লাহ বলেন, দেশের মধ্যে এখন যে পরিস্থিতি আমাদের অভ্যুত্থানের ছাত্র নেতৃত্ব, অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে নব্বইয়ের আন্দোলনটা এই মুহূর্তে ফোকাস আছে, তেমন না। কারণ নব্বইয়ের আন্দোলনটা রাজনৈতিক ছাত্রদের আন্দোলন, এবারের ছাত্র আন্দোলনটা ভিন্ন ধরনের আন্দোলন এবং পরবর্তী সময়ে সরকার পতনের আন্দোলন। সে হিসেবে অনুপ্রেরণা হিসেবে ৯০ এর আন্দোলন ততটা প্রাসঙ্গিক ছিল না। নব্বইয়ের আবেদন এখন সাধারণ ছাত্রদের মাঝে নেই, শুধু পলিটিকাল ছাত্রদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এখন ছাত্র নেতাদের উচিত, আমাদের ছাত্র আন্দোলনের যে ঐতিহ্য, সেই জায়গা থেকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সব ছাত্র আন্দোলনকে চর্চার মধ্যে রাখা।
সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের কেন্দ্রীয় সংসদের সাধারণ সম্পাদক রাফিকুজ্জামান ফরিদ বলেন, স্বৈরাচারবিরোধী ছাত্র প্রতিরোধের যে চেতনা, ছাত্র সমাজের যে বহুল আকাঙ্ক্ষিত শিক্ষা সক্রান্ত ১০ দফা, তার অন্যতম দফা ছিল সার্বজনিন, বৈষম্যহীন, বিজ্ঞানভিত্তিক, একই ধারার একটি শিক্ষা ব্যবস্থার আকাঙ্ক্ষা। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের ৩৫ বছর পরও সেই দাবি পূর্ণ হয়নি। নব্বইয়ের পরে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় পার্টি পালাক্রমে ক্ষমতায় ছিল, কিন্তু তারা নব্বইয়ের সেই দাবি মানেনি, পূরণ করেনি। ফলে এক গণঅভ্যুত্থান পেরিয়ে আমরা আরেক গণঅভ্যুত্থানে এসেছি, একই চিত্র আমরা দেখেছি, সেটা আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়েছে। এই যে বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণের আকাঙ্ক্ষা ছাত্র সমাজ ব্যক্ত করেছে, সেটা একটা গণতান্ত্রিক শিক্ষাব্যবস্থা ছাড়া বিনির্মাণ সম্ভব নয়।
ছাত্র অধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি বিন ইয়ামিন মোল্লা বলেন, আমাদের ভূখণ্ডের যে রাজনৈতিক ইতিহাস, যারা স্বৈরাচার হয়ে ওঠার চেষ্টা করেছে বা হয়ে উঠেছে তাদেরই পতন হয়েছে। প্রত্যেক স্বৈরাচার পতনের ধ্বনি তুলেছে ছাত্ররা। সেই নেতৃত্বের সূচনাও করেছে ছাত্ররা। চব্বিশের ছাত্র আন্দোলনের তাৎপর্য এটাই, অতীতে স্বৈরাচারের পতনের আন্দোলন ছাত্রদের হাত ধরে শুরু হলেও এর পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রের গুণগত পরিবর্তনে ছাত্রদের চিন্তায় ও সাধারণ মানুষের চিন্তাগুলো বাস্তবায়ন হয়নি। এবার একটা সম্ভবনার দরজা উন্মোচন হয়েছে। কারণ তারুণ্য নির্ভর রাজনৈতিক দল আছে, আরও তারুণ্য নির্ভর শক্তি আছে, তৈরি হচ্ছে। রাষ্ট্র ব্যবস্থার গুণগত পরিবর্তন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ন্যায়বিচারের যে আকাঙ্ক্ষা এটি বাস্তবায়নের জন্য কাজ করার সুযোগ আছে।
এদিকে স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে প্রতি বছরের মতো এবারও রাজনৈতিক দল এবং ছাত্র সংগঠনগুলো শিক্ষা ভবনের মোড়ে শিক্ষা অধিকার চত্বরে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করবে।
দিবসটি উপলক্ষে স্বৈরাচারবিরোধী ছাত্র পরিষদ (১৯৮২-১৯৯০) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি বলেছে, রাজনৈতিক সংগ্রামের ইতিহাসে ভাষা আন্দোলন যেমন প্রতিরোধের সূচনা করেছিল, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান যেমন প্রতিরোধ আন্দোলনকে উচ্চতর পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল, ৭১ এর মার্চের আন্দোলন যেমন পূর্ব বাংলার জনগণের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে বিকশিত করেছিল ও স্বতন্ত্র রাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পথ নির্মাণ করেছিল এ সবেরই ধারাবাহিকতায় ঘটেছিল ১৪ ফেব্রুয়ারি সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলন। এটা পরবর্তীকালে বিকশিত হয়ে সৃষ্টি করেছিল ১৯৯০ সালের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান।