মারণাস্ত্র ও ছররা গুলি নিষিদ্ধের প্রস্তাব দেবেন ডিসিরা

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের শাসনামলে আগামী ১৬ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে প্রথম জেলা প্রশাসক (ডিসি) সম্মেলন। ডিসিরা জনবিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক মারণাস্ত্র ও ছররা গুলির ব্যবহার নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব সম্মেলনে দেবেন বলে জানা গেছে। থাকছে সার্কিট হাউজ, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, পুলিশ সুপারের কার্যালয়, জেলা প্রশাসকের বাসভবনকে কেপিআই নিরাপত্তায় অন্তর্ভুক্তকরণের প্রস্তাবও। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

জানা গেছে, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো কয়েকজন ডিসির পাঠানো খসড়া প্রস্তাবে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ের জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, ছররা গুলি মানবদেহে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। এ ছাড়া গুলিতে প্রাণহানির কথাও উল্লেখ করেন তাদের কেউ কেউ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ ডিসিদের করা এমন প্রস্তাবে সায় দিয়ে মতামত তৈরি করেছে বলেও জানা গেছে।

মাঠ পর্যায়ে সরকারের প্রতিনিধি এবং নীতিনির্ধারক হিসেবে পরিচিত ডিসি ও বিভাগীয় কমিশনারদের সঙ্গে সরাসরি মতবিনিময় এবং বর্তমান সরকারের প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা দেওয়ার জন্য জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) সঙ্গে প্রথমবারের মতো বৈঠকে বসছেন অন্তর্বর্তী সরকার। আগামী ১৬ ফেব্রুয়ারি (রবিবার) তিনদিনের জেলা প্রশাসক (ডিসি) সম্মেলনের মাধ্যমে শুরু হচ্ছে এই বৈঠক। শেষ হবে ১৮ ফেব্রুয়ারি (মঙ্গলবার)। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এটিই হতে যাচ্ছে প্রথম ডিসি সম্মেলন।

জানা গেছে, দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে এবারের ডিসি সম্মেলনটি হবে তিন দিনব্যাপী। এ বছরের মার্চে অনুষ্ঠিত সবশেষ ডিসি সম্মেলনটি হয়েছিল চার দিনব্যাপী। চলতি বছরের ৩ থেকে ৬ মার্চ অনুষ্ঠিত হয় এ সম্মেলন। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের জেলা ও মাঠ প্রশাসন অধিশাখা এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের জেলা ও মাঠ প্রশাসন অধিশাখা কর্তৃক জানা গেছে, এখন পর্যন্ত নেওয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সম্মেলনের কার্য অধিবেশনগুলো ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হবে। তবে অন্য ভেন্যুও বিবেচনায় রয়েছে, তবে সেগুলো সম্পর্কে এখনও নিশ্চিত নয়।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, আগামী ১৬  ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টায় ডিসি সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে ডিসি সম্মেলনের উদ্বোধন করবেন তিনি। আসন্ন ডিসি সম্মেলনে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সঙ্গে ডিসিদের কার্য-অধিবেশন, এ ছাড়া একটি উদ্বোধন অনুষ্ঠান, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে মুক্ত আলোচনা, বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ অনুষ্ঠিত হবে। প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ অনুষ্ঠিত হবে। এ ছাড়াও তিন দিন শেষে একটি সমাপনী অনুষ্ঠান থাকবে। জাতীয় সংসদ কার্যক্রম চলমান নেই বলে এবারের ডিসি সম্মেলনে জাতীয় সংসদের স্পিকারের সঙ্গে ডিসিদের মতবিনিময় সভাটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে না বলে জানা গেছে।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে এবারের সম্মেলনে মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীদের পরিবর্তে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা উপদেষ্টারা উপস্থিত থাকবেন। কার্য-অধিবেশনগুলোতে মন্ত্রণালয় ও বিভাগের প্রতিনিধি হিসেবে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা উপদেষ্টা, সিনিয়র সচিব ও সচিবরা উপস্থিত থাকবেন। সম্মেলন উপলক্ষে জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনাররা লিখিতভাবে মাঠ প্রশাসনের সমস্যাগুলো নিয়ে প্রস্তাব দিচ্ছেন। অধিবেশনের সময় এগুলো ছাড়াও ডিসিরা তাৎক্ষণিক বিভিন্ন প্রস্তাব তুলে ধরবেন। কার্য অধিবেশনগুলোতে সভাপতিত্ব করবেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. শেখ আব্দুর রশিদ।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এবারের ডিসি সম্মেলনে কয়েকজন ডিসি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ক্ষেত্রে বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং জেলার গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো যেমন– সার্কিট হাউজ, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, পুলিশ সুপারের কার্যালয়, জেলা প্রশাসকের বাসভবনকে কেপিআই নিরাপত্তায় অন্তর্ভুক্তকরণের প্রস্তাব দিয়েছেন। কয়েকজন ডিসি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্তব্যরত অবস্থায় বাধ্যতামূলক বডি ক্যামেরা ব্যবহার নিশ্চিতকরণের প্রস্তাব দিয়েছেন। এসব প্রস্তাবের পক্ষে মতামত দিয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে চিঠি পাঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে মন্ত্রণালয়।

উল্লেখ্য, সরকারের নীতিনির্ধারক এবং জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনারদের মধ্যে সামনা-সামনি মতবিনিময় এবং প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা দেওয়ার জন্যই সাধারণত প্রতি বছর জুলাই মাসে ডিসি সম্মেলনের আয়োজন করা হতো। কিন্তু এ বছর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে তা সম্ভব হয়নি। এবারের ডিসি সম্মেলনের কার্য-অধিবেশনগুলোতে মন্ত্রণালয় ও বিভাগের প্রতিনিধি হিসেবে উপদেষ্টা, সিনিয়র সচিব ও সচিবরা উপস্থিত থাকবেন। প্রতি বছরের মাঝামাঝি জুন-জুলাইয়ে ডিসি সম্মেলনের আয়োজন করা হলেও করোনা মহামারির কারণে এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটে। করোনার কারণে ২০২০ এবং ২০২১ সালে ডিসি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়নি। ২০২২ সালের ১৮ থেকে ২০ জানুয়ারি এ সম্মেলন হয়। ২০২৩ সালে ডিসি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ২৪ থেকে ২৬ জানুয়ারি। সর্বশেষ সম্মেলন ২০২৪ সালের ৩ থেকে ৬ মার্চ চার দিন অনুষ্ঠিত হয়েছে।

সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মুক্ত আলোচনাসহ তিন বাহিনীর প্রধানদের সঙ্গেও মতবিনিময় করেন ডিসিরা। তবে ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর এবারের সম্মেলন প্রধানমন্ত্রীর পরিবর্তে প্রধান উপদেষ্টা উদ্বোধন করবেন। তার সঙ্গে মুক্ত আলোচনায় অংশ নেবেন ডিসিরা।

এবারের ডিসি সম্মেলন সামনে রেখে কার্যপত্র তৈরি করতে যথারীতি বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকদের কাছ থেকে প্রস্তাব আহ্বান করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। সে অনুযায়ী নিজ বিভাগ ও দফতর সম্পর্কিত নানা ধরনের প্রস্তাব প্রেরণ করেছেন বিভাগীয় কমিশনার ও ডিসিরা। রুলস অব বিজনেস অনুযায়ী, এসব প্রস্তাব স্বল্প মেয়াদে (এক বছর), মধ্য মেয়াদে (তিন বছর) ও দীর্ঘ মেয়াদে (পাঁচ বছর) বাস্তবায়নযোগ্য কি না, সে ব্যাপারে মতামত চেয়ে গত ২৫ নভেম্বর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বরিশাল বিভাগের একজন, রাজশাহী বিভাগের একজন ও চট্টগ্রাম বিভাগের একজন জেলা প্রশাসক বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন, এবারের ডিসি সম্মেলন অতীতের যে কোনও ডিসি সম্মেলন থেকে ব্যতিক্রম। কারণ উল্লেখ করে তারা বলেন, অতীতে রাজনৈতিক দল পরিচালিত সরকারের দিক-নির্দেশনা সম্বলিত প্রস্তাব থাকতো এবং তা অনুমোদন হতো। এবার এর ব্যতিক্রম। বর্তমান সরকার রাজনৈতিক দলের নয় বলে এবারের ডিসি সম্মেলন হবে পুরোটাই আলাদা।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের যুগ্মসচিব মোহাম্মদ খোরশেদ আলম খান জানিয়েছেন, সব কিছু ঠিক থাকলে আগামী ১৬ ফেব্রুয়ারি ৩ দিনব্যাপী ডিসি সম্মেলন উদ্বোধন করবেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ওই দিন সকাল ১০টায় প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের শাপলা হলে ডিসি সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হবে। কার্য অধিবেশনগুলো অনুষ্ঠিত হবে ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে। তবে এর পরিবর্তন হলে তা জানিয়ে দেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।