বাংলাদেশ সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সাত নম্বর ভবনের প্রায় চারটি ফ্লোরে থাকা কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। বুধবার (২৫ ডিসেম্বর) রাত ১টা ৫০ মিনিটের দিকে লাগা আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের ২০টি ইউনিট প্রায় ৬ ঘণ্টা চেষ্টার পর নিয়ন্ত্রণে আসে। দেশের প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয়ে এত বড় আগুনের ঘটনা কীভাবে ঘটলো, এটা নাশকতা নাকি দুর্ঘটনা? এ নিয়ে সরকারের বিভিন্ন মহলসহ সাধারণ মানুষের মাঝেও আলোচনা, কৌতূহল ও প্রশ্ন রয়েছে।
সচিবালয়ে আগুনের ঘটনার পেছনে আমলাতান্ত্রিক ষড়যন্ত্র থাকতে পারে বলেও মন্তব্য করেছেন অনেকে। আগুনের ঘটনা উদঘাটন করতে ৮ সদস্যের উচ্চ পর্যায়ের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে সরকার। এই কমিটি তিন দিনের মধ্যে প্রাথমিক প্রতিবেদন জমা দেবে বলেন জানিয়েছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা জানান।
বুধবার (২৫ ডিসেম্বর) দিবাগত রাত ১টা ৫০ মিনিটে সচিবালয়ে সাত নম্বর ভবনের ষষ্ঠ তলায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। পরে রাত ১টা ৫২ মিনিটে খবর পেয়ে ১টা ৫৬ মিনিটে ফায়ার সার্ভিসের কয়েকটি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করে। আগুনের ভয়াবহতা বেড়ে যাওয়ায় ফায়ার সার্ভিসের আরও ১২টি ইউনিট বাড়িয়ে টানা প্রায় ৬ ঘণ্টা চেষ্টার পর বৃহস্পতিবার (২৬ ডিসেম্বর) সকাল ৮টা ৫ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। আরও ৪ ঘণ্টা পর দুপুর পৌনে ১২টার দিকে আগুন সম্পূর্ণ নির্বাপণ করতে সক্ষম হয় ফায়ার সার্ভিস। আগুন নিয়ন্ত্রণের কাজ করতে গিয়ে রাত পৌনে ৩টার দিকে সচিবালয়ের সামনে ট্রাকচাপায় সোয়ানুর জামান নয়ন (২৪) নামে একজন ফায়ার ফাইটার নিহত হন।
সচিবালয়ের সাত নম্বর ভবনে লাগা আগুনে ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম ও নবম তলায় অবস্থিত বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ ফাইলসহ নথিপত্র বেশিরভাগই পুড়ে গেছে বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ জাহেদ কামাল। বৃহস্পতিবার সকালে সচিবালয় পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের তিনি এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, ‘আগুন নিয়ন্ত্রণে তাদের ২০টি ইউনিট ও ২১১ জন ফায়ারকর্মী কাজ করেছেন। আগুনে ছয় তলা, সাত তলা, অষ্টম তলা ও নবম তলা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’ বিদ্যুৎ লাইন থেকে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং শর্টসার্কিট থেকে আগুন লাগতে পারে বলে প্রাথমিক ধারণা করেন তিনি।
সচিবালয়ে লাগা আগুন এত দ্রুত কীভাবে ছড়িয়ে পড়েছে এবং আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ফায়ার সার্ভিসের এত সময় কেন লেগেছে জানতে চাইলে সংস্থার ডিজি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ জাহেদ কামাল বলেন, ‘সচিবালয়ের ভেতরে তুলনামূলক জায়গার সংকট আছে। আমাদের বড় গাড়ি ঠিকমতো ভেতরে যেতে পারেনি। এছাড়া সচিবালয়ের ভেতরে কয়েকটি স্তরে নিরাপত্তা গেট রয়েছে। প্রতিটি গেট বন্ধ ছিল, দরজা-জানালাও বন্ধ ছিল। সব মিলিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে কিছুটা সময় লেগেছে।’ কীভাবে আগুন লেগেছে প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে ধারণা করা যাচ্ছে—ইলেক্ট্রিক শর্টসার্কিট থেকে আগুন লাগতে পারে এবং বিদ্যুতের তারের মাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে।’
সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা পরিকল্পিত বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সিনিয়র চিফ পেটি অফিসার মো. আমিনুল ইসলাম। বৃহস্পতিবার (২৬ ডিসেম্বর) সকালে সচিবালয়ের ভেতরে পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘সচিবালয়ে লাগা আগুন শর্টসার্কিটের নয়, বরং পরিকল্পিতভাবে কেউ হয়তো আগুন লাগিয়েছে। শর্টসার্কিট থেকে আগুন লাগলে যেকোনও এক পাশ থেকে লাগতো। এখানে দেখা গেছে বিভিন্ন স্থান থেকে আগুন লেগেছে। এটা শর্টসার্কিটে হয়নি, পরিকল্পিতভাবে কেউ হয়তো আগুন লাগিয়েছে। কে, কারা বা কীভাবে আগুন লাগিয়েছে, সেটা তদন্তে বেরিয়ে আসবে।’
বৃহস্পতিবার সকালে সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘সচিবালয়ে আগুনের ঘটনাটি ষড়যন্ত্রের অংশ কিনা, কিংবা এর পেছনে নাশকতা আছে কিনা—সেটি তদন্তের আগে বলা যাবে না। এ ঘটনা তদন্তের জন্য একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি গঠন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তারাই প্রকৃত ঘটনার রহস্য উদঘাটন করবে।’ সচিবালয়ের মতো এত সুরক্ষিত একটা জায়গায় কীভাবে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলো—এমন প্রশ্নে উপদেষ্টা বলেন, ‘অ্যাক্সিডেন্ট (দুর্ঘটনা) তো সব জায়গায় হতে পারে। এজন্যই তো অ্যাক্সিডেন্ট বলে। সচিবালয়ে হতে পারে বলেই তো ভেতরে (ফায়ার সার্ভিসের) গাড়ি রাখা হয়।’