৫ আগস্ট বাংলাদেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ঢাকা ও দিল্লির মধ্যে রাজনৈতিক দূরত্ব ও বিশ্বাসের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, শেখ হাসিনা এবং তার সরকারের পতনকে ভারতের সরকার, দেশটির রাজনীতিবিদ, মিডিয়া কেউই মেনে নিতে পারছে না। এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশ নিয়ে ভারতীয় সরকারসহ বিভিন্ন রাজনীতিকের নেতিবাচক মন্তব্য এবং ভারতীয় মিডিয়ায় বাংলাদেশ নিয়ে মিথ্যা তথ্য ও অপপ্রচার।
এরই প্রেক্ষাপটে দুই দেশের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠককে ইতিবাচক হিসাবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। সাবেক কূটনীতিকদের মতে, দুই নিকট প্রতিবেশীর মধ্যে বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে মতপার্থক্য থাকাটাই স্বাভাবিক এবং সেগুলো দূর করা বা কমিয়ে আনার জন্য আলোচনার কোনও বিকল্প নেই। পররাষ্ট্র সচিব মো. জসীম উদ্দিনের সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি সোমবার (৯ ডিসেম্বর) খোলামেলা আলোচনার পর সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন—‘দুদেশ একে অন্যের সঙ্গে কাজ করবে।’ এর পরিপ্রেক্ষিতে সাবেক কূটনীতিকরা বলছেন—দেখতে হবে যে সামনের দিনগুলোতে দুদেশের সহযোগিতা ও যোগাযোগের মাত্রা কতটুকু বৃদ্ধি পায়।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাবেক একজন কূটনীতিক বলেন, ‘বৈঠকের পরে দুই পররাষ্ট্র সচিব সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাদের বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, দুপক্ষের মধ্যে ভালো আলোচনা হয়েছে। ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে— তারা অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে কাজ করবে। আবার বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অস্বস্তিকর বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘তবে একটি বৈঠক দিয়ে গোটা বিষয়টিকে পরিমাপ করার সুযোগ নেই। সামনের দিনগুলোতে দুদেশ কীভাবে আচরণ করে এবং অন্য দেশ সেটির কী ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখায়, সেটির ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেকজন সাবেক কূটনীতিক বলেন, ‘বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুদেশের মধ্যে সহযোগিতা আছে। এর বেশিরভাগ নিয়ে আলোচনা বন্ধ আছে। সামনের দিনগুলোতে যদি এগুলো চালু হয়, তবে বুঝতে হবে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে দুদেশ আন্তরিক।’
দ্বিপক্ষীয় মেকানিজম
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে ৮০টিরও বেশি মেকানিজম আছে। এর মধ্যে পানি, কানেক্টিভিটি, সীমান্ত, নিরাপত্তা ও সুরক্ষা, প্রতিরক্ষা, কনস্যুলারসহ বিভিন্ন বিষয় রয়েছে। দুদেশের মধ্যে মেকানিজমভিত্তিক প্রতিবছর ৪০ থেকে ৫০টি বৈঠক হয়, অর্থাৎ গড়ে মাসে ২ থেকে ৩টি বৈঠক হয়ে থাকে। ৫ আগস্টের পর গত ৪ মাসে ৩ থেকে ৪টি বৈঠক হয়েছে।
এ বিষয়ে সাবেক একজন কূটনীতিক বলেন, ‘প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের প্রায় সব বিষয়ে আলোচনা করার প্ল্যাটফর্ম আছে এবং এই বৈঠকগুলো মোটামুটি হয়ে থাকে। ৫ আগস্টের পর বৈঠকের সংখ্যা অনেক কমে গেছে।’
তিনি বলেন, ‘যদি দেখা যায় সামনের দিনগুলোতে ধীরে ধীরে বৈঠকের সংখ্যা বাড়ে, তাহলে বোঝা যাবে দুদেশের মধ্যে যোগাযোগ ও আলোচনা বাড়ছে।’
আরেকজন কূটনীতিক বলেন, ‘ভারত যদি তাদের ভিসাসেবা দ্রুত স্বাভাবিক করে, সেটিও বাংলাদেশের জন্য একটি ইতিবাচক বার্তা দেবে।’
ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি
বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতের সর্বস্তরে একটি যোগাযোগ ও গ্রহণযোগ্যতা ছিল। শেখ হাসিনার পতনের পর ভারতের সরকার, রাজনীতিবিদ, মিডিয়া, থিংক ট্যাংক, অ্যাকাডেমিয়াসহ সবাই বাংলাদেশ নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণা শুরু করলো। এর প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশেও বিভিন্ন মহল থেকে প্রতিবাদ করা হয়েছে এবং হচ্ছে।
এ বিষয়ে সাবেক একজন কূটনীতিক বলেন, ‘ভারতে নির্বাচনের আগে পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, উড়িষ্যা, ত্রিপুরা, আসামসহ বাংলাদেশের পাশে যে কয়েকটি রাজ্য রয়েছে—সেখানে ‘বাংলাদেশের অনুপ্রবেশকারী’ বা ‘হিন্দু কার্ড’ ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশবিরোধী মনোভাব সবচেয়ে বেশি প্রদর্শন করে হিন্দু ধর্মাবলম্বী দলগুলো।’
তিনি বলেন, ‘৫ আগস্ট বা তার পরবর্তী সময়ে ভারতে কোনও নির্বাচন ছিল না। এখন বাংলাদেশ বা হিন্দু কার্ড ব্যবহার করার মানে হচ্ছে— তারা শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের প্রতি তাদের ইতিবাচক মনোভাব দেখাচ্ছে। এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয়, সেটি হচ্ছে— যারা ভারতে বিজেপি দলের বিরোধী, তারাও বাংলাদেশ নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণা চালাচ্ছে।’
আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, ভারতের সর্বস্তরে বাংলাদেশবিরোধী একটি মনোভাব তৈরি হয়েছে। যত তাড়াতাড়ি তারা নতুন বাস্তবতা মনে নেবে এবং সে অনুযায়ী আচরণ করবে, তত তাড়াতাড়ি দুদেশের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক ফিরে আসবে বলে তিনি জানান।