ভারতের আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনারের কার্যালয়ে ভাঙচুর নিয়ে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে। এই উত্তেজনার রেশ ধরে বাংলাদেশে যেন ভারতীয় হাইকমিশন বা কোনও স্থাপনায়, ভারতীয় নাগরিকদের ওপর হামলা না হয়—সেজন্য সতর্ক রয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। ইতোমধ্যে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে ভারতীয় হাইকমিশনের ভিসা সেন্টারসহ স্থাপনাগুলোতে বিশেষ নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।
একইসঙ্গে বাংলাদেশে কর্মরত বা বসবাসরত ভারতীয় নাগরিক এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর যেন কোনও ধরনের হামলার ঘটনা না ঘটে, সেজন্যও প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কোনও উপাসনালয়ে যেকোনও অপ্রীতিকর ঘটনা ঠেকাতেও সতর্ক রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের কোথাও যেন অপ্রীতিকর কোনও ঘটনা না ঘটে— সেজন্য প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভারত-বাংলাদেশের চলমান কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনতির মাঝেই আগরতলার ঘটনায় ভারতীয় সরকার কিছুটা চাপে পড়েছে। এই মুহূর্তে যদি বাংলাদেশেও সেরকম কোনও ঘটনা ঘটে, তাহলে ভারতের চাপ কমে যাবে। বরং ভারতীয়রা সেই ঘটনা ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে প্রচার করবে। এ কারণে বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার অধিকতর সতর্কতা ও গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টি ‘হ্যান্ডেল’ করছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, রাজধানী ঢাকার বারিধারায় ভারতীয় হাইকমিশন এলাকায় ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। স্বাভাবিক সময়ে যে নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকে, তার চেয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েকগুণ বেশি সদস্য নিয়োজিত করা হয়েছে। যেকোনও ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে সেনাবাহিনীর সদস্যরাও দায়িত্ব পালন করছেন। বারিধারার ভারতীয় হাইকমিশনের সামনে সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া যান মোতায়েন রয়েছে। এছাড়া যমুনা ফিউচার পার্কে ভারতীয় ভিসা সেন্টারসহ ঢাকায় ভারতীয় অন্যান্য স্থাপনায়ও নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের একজন অতিরিক্ত কমিশনার বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, প্রয়োজনের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। চট্টগ্রামের খুলশী থানার জাকির হোসেন রোডে ভারতীয় সহকারী হাইকমিশনের সামনে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন থাকতে দেখা গেছে। এছাড়া পূর্ব নাসিরাবাদে সিডিএ অ্যাভিনিউয়ের সিটি সেন্টারে ভারতীয় ভিসা আবেদন কেন্দ্রের নিরাপত্তাও বাড়ানো হয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা জানান, রাজশাহীর সপুরা উপশহরে ভারতীয় সহকারী হাইকমিশনারের কার্যালয়, খুলনার বয়রা কলেজ রোডের জলিল সরণিতে সহকারী হাইকমিশনারের কার্যালয়, সিলেটের শাহজালাল উপশহরে সহকারী হাইকমিশনার কার্যালয়েও ব্যাপক নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, সহকারী হাইকমিশনার কার্যালয় ছাড়াও ভারতীয় ভিসা সেন্টারগুলোতে নিরাপত্তা ব্যবস্থাও জোরদার করা হয়েছে। রাজধানী ঢাকা ছাড়া বিভিন্ন মেট্রোপলিটন এলাকা ও জেলায় আরও ১৫টি ভিসা সেন্টার রয়েছে। এগুলো হলো—বরিশাল, যশোর, সাতক্ষীরা, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, রাজশাহী, বগুড়া, রংপুর, ঠাকুরগাঁও, কুষ্টিয়া, খুলনা ও সিলেটে ভিসা সেন্টার। এসব ভিসা সেন্টারে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি সূত্র জানায়, সাম্প্রতিক ইস্যুকে কেন্দ্র করে নতুনভাবে হিন্দু সম্প্রদায়ের কারও ওপর হামলা, উপাসনালয়, অন্যান্য স্থাপনা, ভারতীয় নাগরিকদের ওপর হামলারও শঙ্কা রয়েছে। রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে তৃতীয় পক্ষও এই সুযোগ নিতে পারে—এজন্য অগ্রিম নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্র জানায়, আগরতলার ঘটনায় বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা বিক্ষোভ করলেও সাংগঠনিক কোনও ব্যানারে কেউ যাতে হাইকমিশন বা ভিসা সেন্টার এলাকায় না যায়, সেজন্য সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সংগঠনের নেতাদের সঙ্গেও আলোচনা করে আগাম সতর্ক করা হয়েছে। সংগঠনগুলোকে সরকারের পক্ষ থেকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে, এতে বাংলাদেশ আবারও আন্তর্জাতিকভাবে চাপে পড়তে পারে।
বিবৃতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিবাদ, কর্মসূচিতে ‘সতর্কতা’
ভারতের আগরতলায় বাংলাদেশ মিশনে হামলা, মমতা ব্যানার্জির মন্তব্য ও দেশটিতে বাংলাদেশ নিয়ে নানামুখী গুজবসমৃদ্ধ খবর প্রচারকে কেন্দ্র করে উত্তপ্ত বাংলাদেশের রাজনীতি। মঙ্গলবার (৩ ডিসেম্বর) ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাব ও বায়তুল মোকাররমে বিক্ষোভ করেছে কয়েকটি সংগঠন। এর মধ্যে ইসলামী আন্দোলন, এবি পার্টি, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস উল্লেখযোগ্য।
এদিন বিকালে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদের নেতৃত্বে নয়াপল্টনে একটি বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে। যদিও এ ইস্যুতে বিএনপি কেন্দ্রীয় কোনও কর্মসূচি দেবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
বিশেষ করে ভারত ইস্যুতে বাংলাদেশের মানুষ যেন শান্ত থাকে এবং প্রতিক্রিয়ায় সহিংসতা ঠেকাতে রাজনৈতিক দলগুলো সতর্ক রয়েছে। ইতোমধ্যে সোমবার ও মঙ্গলবার দেশের বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল বিবৃতিতে ভারতের প্রতিবাদ জানিয়েছে।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জামায়াতের সেক্রেটারি মিয়া গোলাম পরওয়ারসহ বিভিন্ন নেতা বিবৃতিতে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। জনসাধারণকে শান্ত থাকার অনুরোধ করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
এ প্রসঙ্গে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘নতুন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার প্রতি তারা (ভারত) শ্রদ্ধাশীল হবেন। প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে আমরা শত্রুতা চাই না। কিন্তু নিজেদের সার্বভৌমত্ব রক্ষায়, দেশের জনগণের অধিকার রক্ষায় আমরা কোনও ছাড় দেবো না।’
বিএনপির দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, আসলে হঠাৎ করে বাংলাদেশ-ভারতের এই উত্তেজনার আড়ালে রাজনীতি কী—তা নিয়ে নেতারা ভাবছেন। গত ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর দেশটির সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্কে কিছুটা ছেদ পড়লেও সোমবার (২ ডিসেম্বর) আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলার ঘটনায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন নেতারা। বিষয়টিকে আরও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করার পক্ষে বিএনপি।