সরকারের আয়-ব্যয়ের পরিকল্পনা বা বাজেটে শিশুদের নিয়ে থাকে না আলাদা কোনও ভাবনা। দেশের ৪০ শতাংশ জনগোষ্ঠী অর্থাৎ ৮ কোটি শিশুর জন্য সুনির্দিষ্ট পৃথক বাজেট না থাকার কারণে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়কে বাজেট বরাদ্দ দিলেও, তা কার্যকর হচ্ছে কি না, এর স্পষ্ট চিত্র নেই। তাই শিশুদের জন্য পৃথক অধিদফতরের দাবি করেছেন অধিকারকর্মীরা।
তারা বলছেন, পৃথক বরাদ্দ ও প্রকল্প না থাকায় দেশের শিশুদের জীবনমান উন্নয়নে কার্যকর কিছু করা যাচ্ছে না। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের যে তৎপরতা, তা পৌঁছাতে পারছে না তাদের কাছে। শিশুর জন্য আলাদা করে বাজেট বরাদ্দ হলে কোনটা দরকার আর কোনটা অধিক দরকার, তা স্পষ্ট হতো।
২০২৪-২৫ বাজেটে বলা হয়েছে, আমাদের মূল লক্ষ্য বাংলাদেশ বিনির্মাণ। তাই শৈশব থেকেই প্রতিটি শিশুর অন্তরে তা জুড়ে দিতে এখন থেকেই পদক্ষেপ নিতে হবে। সে কারণে জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষাকাঠামো ও এর মূল্যায়নপদ্ধতি আধুনিকায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি শিশুদের শিক্ষার প্রাথমিক ধাপেই প্রযুক্তি ব্যবহারে অভ্যস্ত করে তুলতে প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষাদানের ওপর অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এর জন্য বরাদ্দ নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে।
আবার সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতায় এতিমখানায় সমাজের এতিম ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মাথাপিছু অনুদান দিয়ে আসছে। আর শ্রমজীবী শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে সরিয়ে আনতে সরকারের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে এবং এর জন্য বিভিন্ন খাতে বরাদ্দের মন্ত্রণালয়ভিত্তিক অনুদানের উল্লেখ আছে।
মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে নেই সমন্বিত পরিকল্পনা
বর্তমানে প্রায় ২৩টি মন্ত্রণালয় শিশু উন্নয়ন ও অধিকার নিয়ে কাজ করছে। কিন্তু এই মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে নেই সমন্বিত কোনও পরিকল্পনা, সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি গ্রহণ ও তার বাস্তবায়ন। শিশু অধিকার প্রতিষ্ঠায় সরকার ও আদালতের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে নির্দেশনা আসে কিন্তু মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়নে প্রায়ই সমন্বয়হীনতা দেখা যায়। আসলে একটি মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতার দায় অন্য মন্ত্রণালয়ের ওপর চাপানোর প্রবণতাও লক্ষ করা যায়।
শিশুদের জন্য আলাদা বাজেট না থাকলেও অনেক মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে উল্লেখ করে। যেমন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দের বেশির ভাগ, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন কর্মসূচি ও সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি বা গর্ভবতী অথবা স্তন্যদানকারী মায়েদের কেন্দ্র করে সামাজিক নিরাপত্তা বা স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদি। তবে সরাসরি শিশুদের জন্য আলাদা বাজেট নির্ধারণ করা উচিত বলে মনে করেন শিশু অধিকারকর্মীরা। এই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে পৃথক অধিদফতর জরুরি বলেও মনে করেন তারা।
২০২২ সালে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছিলেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে শিশুদের জন্য আলাদা অধিদফতর প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া কিছুটা ব্যাহত হয়েছে। তবে জনপ্রশাসন ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে যত দ্রুত সম্ভব শিশুদের জন্য আলাদা অধিদফতর করা হবে। দুই বছর পার হলেও এখনও তা করা সম্ভব হয়নি।
যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা
শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করেন আবদুল্লা আল মামুন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির ভেতর দিয়ে প্রান্তিক মানুষকে সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু সেখানেও শিশুদের জন্য বিশেষত যে শিশুরা শিশুশ্রমের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে, তারা অভাবের কারণে বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছে। তাদের জন্য আলাদা কোনও সুরক্ষা কর্মসূচি নেই। সার্বিকভাবে শিশুর জন্য দেওয়া হচ্ছে বলা হলেও, কেবল শিশুকে এককভাবে এ ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার সময় এসেছে; যেখানে শিশুর জন্য কী জরুরি এবং কীভাবে খরচ হবে, তার সুস্পষ্ট ধারণা থাকবে।
শিশুর জন্য যে বাজেট, তা কোথায় ব্যয় হলো এবং তার ফলে কী পরিবর্তন হলো, সেটাও নজরে রাখা দরকার উল্লেখ করে তিনি বলেন, যদি শিশুদের ওপর নিবিড়ভাবে বিনিয়োগ করতে না পারি এবং সেটির সমন্বয় ধরে রাখতে না পারি, তাহলে অনেক বিনিয়োগ হবে, অনেক বাজেট হবে কিন্তু তার সুবিধা পাওয়া থেকে অনেক শিশু বাদ পড়ে যাবে।
মন্ত্রণালয়ের শিশু ও সমন্বয় অনুবিভাগ থেকে জানা গেছে, শিশুদের জন্য আলাদা বাজেটের প্রস্তাব না করলেও শিশুদের কথা ভেবে প্রকল্প বরাদ্দ ও বাস্তবায়ন পরিকল্পনা হয়।
শিশু অধিকারকর্মী গওহার নঈম ওয়ারা মনে করেন, শিশুরা এজেন্ডাতেই নেই। তারা বাজেটে আসবে কীভাবে। শিশুরা আমাদের সমাজে অদৃশ্য। আগে শিশুকে এজেন্ডায় আনতে হবে। একভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ তারা, জনগোষ্ঠীর ৪০ শতাংশকে অস্বীকার করার উপায় নেই।
কেন পৃথক বাজেট লাগবে, প্রশ্নে তিনি বলেন, ভুলে গেলে চলবে না শিশুদের কিছু বিশেষ চাহিদা আছে। সে কারণে তাদের নিয়ে আলাদা করে ভাবতে হবে। আমাদের দেশে বড়দের টয়লেটে শিশুদের যেতে হয়, বড়দের বিষয়গুলোর মধ্যে তাদের ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। সেসব থেকে মুক্তি পেতে তাদের পৃথকভাবে দেখতে হবে।
মহিলা ও শিশুবিষয়ক নামে সরকারের একটি মন্ত্রণালয় আছে, যাদের কাজ নারী ও শিশুদের কল্যাণে কাজ করা। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বাজেটের আগে অর্থমন্ত্রীর কাছে চাহিদাপত্র দিলেও এই মন্ত্রণালয় থাকে নীরব।
এ বিষয়ে মহিলা ও শিশুবিষয়ক সচিব নাজমা মোবারেক বলেন, শিশুদের জন্য আলাদা বাজেটের প্রস্তাব করিনি আমরা। তবে আমরা শিশুদের বিভিন্ন শারীরিক-মানসিক বিকাশের নতুন নতুন প্রকল্প নিচ্ছি। আলাদা বাজেট একটু সময় লাগবে, হয়তো ধীরে ধীরে সেদিকে যাওয়া হবে।
৪০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর জন্য নেই অধিদফতর
এ দেশে যুব উন্নয়ন অধিদফতর, মহিলাবিষয়ক অধিদফতর, শ্রম অধিদফতরসহ অনেক অনেক অধিদফতর আছে। এমনকি মাছের সুরক্ষার জন্য মৎস্য অধিদফতর, গাছ ও বনের সুরক্ষার জন্য বন অধিদফতর, প্রাণীদের জন্য আছে প্রাণিসম্পদ অধিদফতর। অথচ দেশের ৪০ শতাংশ জনগোষ্ঠী অর্থাৎ ৮ কোটি শিশুর জন্য নেই আলাদা কোনও অধিদফতর।
বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠী শিশুদের জীবন এমনিতেই বহুমাত্রিক সমস্যায় জর্জরিত। তাই কোনও একটি নির্দিষ্ট কর্মসূচি দিয়ে অথবা একমুখী পরিকল্পনার মাধ্যমে শিশুদের জীবনের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। আর এখানেই শিশুদের জন্য একটি পৃথক অধিদফতরের দাবি বারবার ঘুরেফিরে আসে।
অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, শুধু শিশু অধিদফতরের অভাবে অনেক প্রচেষ্টার বিনিময়ে শিশুকেন্দ্রিক যে বাজেটগুলো কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের জন্য নির্ধারিত হয়েছিল, তার সুষ্ঠু সমন্বয় করা যায়নি। পৃথক শিশু অধিদফতর থাকলে শিশুকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলোর সমন্বয়, বাস্তবায়ন ও তত্ত্বাবধান অনেক সহজে করা সম্ভব হবে।
আলাদা না হলে সমস্যা স্পষ্ট হবে না
সরকারের জেন্ডার বাজেট, শিক্ষাসংক্রান্ত বাজেট, সংস্কৃতি, খেলাধুলা বা এ ধরনের উপখাতগুলোর মতো শিশুদের উন্নয়নে বাজেটে আলাদা কোনও আলোচনা বা ব্যয় পরিকল্পনা না থাকায় সুনির্দিষ্টভাবে এই সমস্যাগুলোর সমাধানে কাজ করা যাচ্ছে না।
স্বাস্থ্য খাতের আওতায় শিশুদের টিকা দেওয়া হয়, কিন্তু এ জায়গায় কিছুটা পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ। পুষ্টির জায়গাতেও ঘাটতি রয়ে যাচ্ছে। শিশু যখন মায়ের গর্ভে থাকে, তখন যদি পুষ্টির প্রয়োজন মেটানো না হয়, তাহলে তাদের ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। সেখানটায় বড় কাজ করার জায়গা আছে। দেশের অনেক শিশু সাঁতার না শিখে ডুবে মারা যাচ্ছে, সহিংসতার শিকার হচ্ছে এবং নানা অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক শিশু সহায়তা সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখেছে, চলতি (২০২৩-২০২৪) অর্থবছরে জাতীয় বাজেটে সরাসরি সুবিধা বা পরোক্ষ সুবিধা মিলিয়ে শিশুদের জন্য বরাদ্দ ছিল ১৪ দশমিক ৯ শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে সেটা ছিল ১৫ দশমিক ৩ শতাংশ। অর্থাৎ চার বছর আগের তুলনায় চলতি অর্থবছরে আনুপাতিক হারে বরাদ্দ কমেছে।
যেহেতু দেশে ৪০ শতাংশেরও বেশি শিশু, তাই তাদের জন্য কী ধরনের বিনিয়োগ করা হচ্ছে, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। ঢালাওভাবে বিনিয়োগ করলে শিশুদের জন্য কত বিনিয়োগ হলো, সেটিকে পরবর্তী সময়ে কীভাবে খরচ করা হলো, সেটি বের করা দুরূহ হয়ে পড়ে। এর মধ্যে মেয়ে শিশুর জন্য কত, ছেলে শিশুর জন্য কত, প্রতিবন্ধী ও প্রান্তিক শিশুর জন্য কত খরচ হবে, তার বিশ্লেষণ প্রয়োজন আছে। এ জন্য শিশুদের বাজেট আলাদা করে দেওয়া উচিত। তাই শিশুবিষয়ক যাবতীয় উন্নয়ন ও সুরক্ষা কাজগুলো দেখভালের জন্য শিশু অধিদফতরের দাবি দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসছে।
সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির ভেতর দিয়ে প্রান্তিক মানুষকে সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে, কিন্তু সেখানেও শিশুদের জন্য, বিশেষ করে যে শিশুরা শিশুশ্রমের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে, যে শিশুরা অভাবের কারণে বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছে, তাদের জন্য আলাদা সুরক্ষা কর্মসূচি থাকা দরকার। আমরা শিশুদের ওপর নিবীড়ভাবে বিনিয়োগ করতে না পারি, সেটির সমন্বয় যদি ধরে রাখতে না পারি, তাহলে অনেক বিনিয়োগ হবে, অনেক বাজেট হবে, অব্যবস্থাপনার কারণে মূলস্রোত থেকে অনেক শিশু বাদ পড়ে যাবে।