আজ ২৮ ফেব্রুয়ারি। ২০১৩ সালের এই দিনে, জামায়াত নেতা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর ফাঁসির রায়ের পর, চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাট পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির সদর দফতরে নাশকতা চালায় জামায়াত-শিবির কর্মীরা। হামলা ভাংচুরের পাশাপাশি চলে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ। পুড়িয়ে দেওয়া হয় শত কোটি টাকার বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি। কিন্তু তিন বছর পরও ধরাছোঁয়ার বাইরে আসামিরা। আর আদালতে এ মামলার চার্জশিট দাখিল হলেও; আইনি জটিলতায় এখনও শুরু করা যাচ্ছে না বিচার কার্যক্রম। সেদিনের সেই ধ্বংসযজ্ঞ ঘটনার বিচার হয়নি এখনও। তাই সংশ্লিষ্ট অপরাধীদের গ্রেফতার করে দ্রুত বিচারের দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
অন্যদিকে, কানসাট পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির ৮০ ভাগ গ্রাহকই শিবগঞ্জ-কানসাট এলাকার হওয়ায়, দ্রুত সংস্কার শেষে কানসাটেই সদর দপ্তর পুনঃস্থাপনের দাবি জানান এলাকাবাসী।
কানসাট এলাকার জাহাঙ্গীর আলম, কামাল হোসেন ও পারদিলারপুর গ্রামের এম ওবায়দুল্লাহ বলেন,‘ অনেক কষ্ট ও আন্দোলনের মাধ্যমে কানসাটে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির সদর দফতর আমরা পেয়েছিলাম। কিন্তু কতিপয় দুস্কৃতকারীর হামলায় এ দফতরটি পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
দুষ্কৃতকারীদের কারণে এলাকার সাধারণ জনগণ ও গ্রাহকরা কেন শাস্তি পাবে এমন প্রশ্নও তোলেন তারা। এখন জেলা শহরে ৩০-৩৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে কাজ করতে যেতে অসুবিধা হচ্ছে এমন অভিযোগও করেছেন এসব গ্রামবাসী।
গ্রামবাসীরা বলেন, এই মুর্হুতে আমরা শিবগঞ্জ থানার গ্রাহকরা দুর্বিষহ জীবন যাপন করছি। এছাড়া সদরে গিয়ে একদিনের কাজ আমাদের পাঁচদিনে করতে হচ্ছে। এই অবস্থায় আমরা সরকারের কাছে কানসাটেই সদর দফতর চালুর জোর দাবি জানাচ্ছি। দুষ্কৃতকারীদের দ্রুত বিচারের মাধ্যমে শাস্তি নিশ্চিত করলে আগামীতে এ ধরনের সরকারি প্রতিষ্ঠানে আর কেউ হামলার সাহস পাবে না বলেও জানান এলাকাবাসী।
এলাকাবাসী আরও জানান, জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসেন সাঈদী মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত হওয়ার পর সেদিন কয়েক দফায় জামায়াত-সমর্থকরা কানসাট পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির প্রশাসনিক ভবন, গোডাউন, পাওয়ার সাপ্লাই রুম, সুইচ রুম, রেস্ট হাউজসহ সমিতি চত্বরে থাকা পিক-আপ ভ্যান, জিপ, প্রাইভেট কার, মটরসাইকেল এবং ট্রান্সফরমার ও বৈদ্যুতিক বিভিন্ন সরঞ্জাম ভাংচুর ও লুটপাট করে এবং আগুন দেয়। তাদের কবল থেকে রক্ষা পায়নি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কোয়ার্টারে বসবাসরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পরিবারের সদস্যরা। এ সময় কোয়ার্টার থেকে পালিয়ে প্রাণ রক্ষা করেন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পরিবারের নারী-শিশু সদস্যরা। এ ঘটনার ৩ বছর পার হলেও এখনও বিচার কাজ সম্পন্ন না হওয়ায় হতাশ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
সেদিনের সেই ধ্বংসযজ্ঞের প্রত্যক্ষদর্শী, কানসাট পল্লী বিদ্যুতের ডাটা এন্ট্রি অফিসার শেফালি খাতুন, জেনারেল ম্যানেজারের গাড়িচালক আব্দুর রশিদ ও টেকনিশিয়ান মিজানুর রহমান জানান, ধ্বংসযজ্ঞ এতোটাই ভয়াবহ ছিলো যে, নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। অন্যান্য দিনের মতোই আমরা স্বাভাবিক কাজকর্ম করছিলাম। দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর রায় ঘোষণার পর আনুমানিক দুপুর ২টার দিকে তারা মুখোশ পরিহিত অবস্থায় মিছিল নিয়ে গেট ভেঙে অর্তকিত হামলা করে। আমরা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ি। গেটের আনসাররা বাধা দিলেও তাদের হামলার মুখে ওরা টিকতে পারেনি। দুপুর থেকে কয়েক দফায় তারা কানসাট পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কার্যালয়সহ রেস্ট হাউজে হামলা চালায়। তারা লুটপাট করে ও আগুন দিয়ে আমাদের সব কিছু শেষ করে দেয়। এমনকি আমাদের টাকা-পয়সা, সোনার গয়না, কাপড়, আসবাবপত্র সব কিছুই সেদিন লুটপাট করে নিয়ে যায় তারা। সেদিন আমাদের যে ক্ষতি হয়েছে তা পূরণ হওয়ার নয়। আমরা দোষীদের দ্রুত বিচার চাই।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি বোর্ডের সাবেক সভাপতি মনিরুল ইসলাম ও বর্তমান জেনারেল ম্যানেজার প্রকৌশলী হাসান শাহনাওয়াজ জানান, ‘কানসাটে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি অফিসে জামায়াত-বিএনপি’র ধ্বংসযজ্ঞ হামলা ৭১’র পাক হানাদার বাহিনীর বর্বরতাকেও হার মানায়। সেদিনের সেই ভয়াবহ তাণ্ডব নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। বিদ্যুৎ নিয়ে আন্দোলনের সময় ১৭ জন প্রাণ হারালেও; সে বিভীষিকাও এতটা ভয়াবহ ছিল না। অথচ তাদের দায়েরকৃত ৩টি মামলায় অনেক আসামি প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ালেও পুলিশ তাদের এখনও ধরছে না’
সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর এ.বি.এম সাইদুল ইসলাম জানান, ‘৩টি মামলায় ৪শ’ ১৭ জন আসামির বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দেয় পুলিশ এবং প্রায় ১শ’ ৫০ জন আসামির জামিন হলেও মামলার বাকি আসামিরা পলাতক ও আদালতে হাজির না হওয়ায় মামলাগুলো বিচারের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে না। ফলে, বিচার কার্যক্রম শুরু হচ্ছে না। ফলে এ অবস্থায় এক ধরনের বিচার বিভ্রাটের সৃষ্টি হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘এ বিচার তরান্বিত করতে হলে আইনের কিছু সংশোধনীও দরকার। কারণ এখানে পুলিশ প্রশাসন, বিচারক ও আইনজ্ঞদের বিষয় জড়িত। সুতরাং সবাই মিলে এ ব্যাপারে সজাগ না হলে এই মামলার বিচার কার্যক্রম দীর্ঘদিন ধরে ঝুলেই থাকবে।’
শিবগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ এম এম ময়নুল ইসলাম জানান,‘৩টি মামলায় প্রায় দেড় শতাধিক আসামিকে এখন পর্যন্ত গ্রেফতার করা হয়েছে। আদালতে বিচারের প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে এখন যেসব পলাতক আসামি আছে যাদের আমরা পাচ্ছি না: তাদের বিরুদ্ধে আদালতে এখন আমরা নন এক্সিকিউশন রিপোর্ট দিচ্ছি। বিজ্ঞ আদালত এখন তাদের বিরুদ্ধে পলাতক দেখিয়ে বিজ্ঞপ্তি দিলে বিচার প্রক্রিয়া শেষ করতে পারবেন। আমরাও আশা করবো অনতিবিলম্বে আদালত এ প্রক্রিয়াগুলো শেষ করে এই মামলাগুলোর বিচার প্রক্রিয়াকে একটা অবস্থানে নিয়ে আসতে পারবেন এবং যারা দোষী তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত হবে।’
ভয়াবহ সেই তাণ্ডবের কথা মনে করে এখনও আঁতকে উঠেন এখানকার মানুষ। সেদিনের সেই হামলায় ক্ষতি হয়, প্রায় ২শ’ কোটি টাকার রাষ্ট্রীয় সম্পদ। আর ৪ মাস বিদ্যুৎ না থাকায় সেচের অভাবে নষ্ট হয়ে যায় অন্তত ১২শ’ হেক্টর জমির ফসল। বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে ৫৫ হাজার গ্রাহক।
/টিএন/