দেশে রওনা দেওয়ার আগে করণীয় জানিয়েছিলেন শেখ হাসিনা

দীর্ঘ ৬ বছর প্রবাসে থাকার বাধ্যবাধকতা শেষে স্বদেশে রওনা হওয়ার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দিল্লিতে বসে একটি বিবৃতি দেন। বিবৃতিতে তিনি জানান, মরহুম পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন সোনার বাংলা রূপায়ণের প্রচেষ্টাকে এগিয়ে নেওয়াই তার দায়িত্ব। ১৯৮১ সালের ১৬ মে দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম পাতায় সেই খবর প্রকাশিত হয়।

ইত্তেফাকের সংবাদে জানানো হয়, ‘তিনি দেশে ফিরলেই তার দল রাজনৈতিক কর্মসূচি ও সংগ্রামের কৌশল নির্ধারণ করবে। বাংলাদেশে রওনা হওয়ার আগে দিল্লিতে সংবাদপত্রে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, মরহুম পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন সোনার বাংলা রূপায়ণের প্রচেষ্টাকে এগিয়ে নেওয়াই তার দায়িত্ব।’

দেশে ফিরেই ১৯৮১ সালের ১৭ মে বঙ্গবন্ধুকন্যা সাংগঠনিক ঐক্যের ডাক দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘আসুন, আবার আমরা এক হই।’ স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর শেখ হাসিনা এই দিন সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগ আয়োজিত গণসংবর্ধনা সমাবেশে কান্নাজড়িত কণ্ঠে জনগণের কাছে তার পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার বিচার দাবি করেন।

দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত খবর

এর আগে দেশে ফেরার দিন দিল্লিতে তার পিতার ঠিক করা চার রাষ্ট্রনীতি—জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের আদর্শের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এসব মৌল দিকনির্দেশনার প্রশ্নে কোনও আপস নাই।’ দিল্লিতে তার অবস্থানকালে প্রদর্শিত সব সহানুভূতি ও সৌজন্যের জন্য তিনি ভারতের সরকার ও জনগণকে ধন্যবাদ জানান। দ্ব্যর্থহীন সহমর্মিতা ও বিবেচনার জন্য তিনি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে এবং সহানুভূতিশীল অন্যান্য নেতৃত্বকেও ধন্যবাদ জানান। বিবৃতিতে শেখ হাসিনা ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট তার পিতা ও ৩ নভেম্বর আওয়ামী লীগের চার নেতার হত্যাকারীদের বিচারের দাবি করেন।

বাংলাদেশে দলীয় প্রস্তুতি

১৯৮১ সালের ১৭ মে তারিখের ইত্তেফাকে সেদিনের কর্মসূচি ও করণীয় প্রকাশিত হয়। দিনটি ছিল আওয়ামী লীগের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

খবরের শিরোনাম ছিল—‘শেখ  হাসিনা আজ আসিতেছেন।’ খবরে বলা হয়, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বিকাল ৩টায় কলকাতা থেকে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সযোগে ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছাবেন। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার কিছু দিন পূর্বে তিনি দেশের বাইরে যান। এরপর এই প্রথম তিনি দেশে ফিরছেন। বিমানবন্দরে দলীয় সভানেত্রীকে অভ্যর্থনা জ্ঞাপন এবং বিকালে শেরেবাংলা নগরে সুপ্রশস্ত মানিক মিয়াতে সংবর্ধনা জ্ঞাপনের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়। বিমানবন্দর থেকে শেখ হাসিনা শেরেবাংলা নগরে আসবার পথে বনানী গোরস্থানে দলের নিহত নেতৃবৃন্দ ও আত্মীয়-স্বজনের মাজার জিয়ারত করবেন।’

১৯৮১ সালের ১৭ মে পত্রিকায় প্রকাশিত খবরইত্তেফাকে প্রকাশিত খবরে আরও জানানো হয়, অভ্যর্থনা জ্ঞাপন হতে শুরু করে গণসংবর্ধনা পর্যন্ত সমগ্র পর্যায়ে শৃঙ্খলা বিধানের জন্য আওয়ামী লীগের বিশেষ স্বেচ্ছাসেবক দল মোতায়েন করা হবে। দলের পক্ষ থেকে সমর্থক ও জনসাধারণের জ্ঞাতার্থে অভ্যর্থনা ও গণসংবর্ধনায় অংশগ্রহণের বিশদ নিয়ম ও করণীয় প্রচার করা হয়। শেখ হাসিনাকে অভ্যর্থনা জ্ঞাপনকারী দলের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ, দলের সংসদীয় সদস্যবৃন্দ এবং সংবাদ সংগ্রহকারী সাংবাদিকদের নিয়ে গাড়ি বঙ্গবন্ধু এভিনিউ থেকে বিমানবন্দরে রওনা হয়। কর্মীদের জানিয়ে দেওয়া হয়, মোটর বহরের লোকজন ব্যতীত বাকি যানবাহন ও অভ্যর্থনাকারীরা বিমানবন্দর এলাকায় প্রবেশ না করে বিমানবন্দরের বাইরে ময়মনসিংহ সড়কে সারিবদ্ধভাবে অপেক্ষা করবে। দলের কর্মসূচি অনুযায়ী, শেখ হাসিনাকে নিয়ে নেতৃবৃন্দের গাড়ি ও শৃঙ্খলা রক্ষাকারীদের যানবাহন বিমানবন্দর থেকে বের হয়ে এলে, তার পেছনে সারিবদ্ধভাবে অন্যান্য যানবাহন শেরেবাংলা নগরে দিকে রওনা হবে এবং বনানী গোরস্থানে শেখ হাসিনার গাড়ি, অন্যান্য নেতার যানবাহন ও সাংবাদিকদের গাড়ি ছাড়া কেউ প্রবেশ করতে পারবে না। কবর জিয়ারতের সময় স্লোগান ও মাইক্রোফোন বন্ধ রাখতে হবে। এছাড়া নগর আওয়ামী লীগের শৃঙ্খলা রক্ষাকারী ওয়ার্ডের স্বেচ্ছাসেবীদের পরামর্শ ও প্রচারের প্রতি লক্ষ রেখে আবশ্যকীয় সহযোগিতা করতে অনুরোধ জানানো হয়। আরও জানানো হয় যে, ফেরার পরের দিন সকাল ৯টায় দলীয় কার্যালয়ে কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদ নেতৃবৃন্দ জেলাগুলোর সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে শেখ হাসিনা সাক্ষাৎ করবেন। সকাল ১০টায় তাদের নিয়ে জাতীয় স্মৃতিসৌধ, মিরপুর বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ ও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন বলে জানানো হয়।

অবশেষে ১৯৮১ সালের এদিন বিকাল সাড়ে ৪টায় ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের একটি বোয়িং বিমানে ভারতের রাজধানী দিল্লি থেকে কলকাতা হয়ে তৎকালীন ঢাকার কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে এসে পৌঁছান শেখ হাসিনা। ওই দিন বৈরী আবহাওয়া উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধুকন্যাকে একনজর দেখতে ছুটে আসেন লাখো মানুষ। সেদিন মিছিলের শহরে পরিণত হয় রাজধানী ঢাকা। সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত চলে স্লোগান। ঝড়-বৃষ্টিও মিছিলের গতিরোধ করতে পারেনি।