সমাজ সভ্যতার চাকা এগিয়ে নেওয়ার কাজটি নারী- পুরুষ সমান তালে এগিয়ে নিলেও নারীর জন্য সমঅধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি এখনও। দেশের শিক্ষা, কৃষি বা অর্থনীতি— সর্বত্র তার পদচারণা নিশ্চিত করলেও সমতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ এখনও বহুদূর। ফলে নারী অধিকারকর্মীরা মনে করেন, নারীর কোটা তুলে দেওয়ার প্রয়োজন এখনও শেষ হয়নি।
গত ৫১ বছরে বাংলাদেশ দারিদ্র্য বিমোচন, নারী শিক্ষা, শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণে অনেক এগিয়ে গেলেও নারী-পুরুষ সমতা নিশ্চিত করতে যেসব সংস্কার প্রয়োজন, সেসব সংস্কার বাস্তবায়নে পিছিয়ে আছে। বিশ্বব্যাংকের ‘ওমেন, বিজনেস অ্যান্ড দ্য ল-২০২৩’ শীর্ষক প্রতিবেদন বলছে— নারীদের অর্থনৈতিক সুরক্ষা পাওয়ার দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বে পেছনের সারির দেশগুলোর মধ্যে একটি। এমনকি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটে ডুবতে বসা পাকিস্তানেরও অনেক পেছনে পড়ে আছে বাংলাদেশ। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের চেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে শুধু আফগানিস্তান। বিশ্বের ১৯০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৪তম, আর পাকিস্তানের র্যাংক ১৫৭।
তবে এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে হলে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত ও নারীকে বাড়তি কিছু সুবিধা দিয়ে সমতার জায়গায় আনা জরুরি বলে মনে করেন নারী অধিকারকর্মী ও অর্থনীতিবিদরা। এবং নারীর জন্য বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে কোটার ব্যবস্থা থাকা দরকার বলেও মনে করেন তারা। যদিও ২০১৮ সালে জনপ্রশাসন সচিব ফয়েজ আহম্মদের সইয়ে জারি করা এক পরিপত্রে বলা হয়— নবম গ্রেড (আগের প্রথম শ্রেণি) এবং দশম থেকে ১৩তম গ্রেডের (আগের দ্বিতীয় শ্রেণি) পদে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি বাতিল করা হলো। এখন থেকে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হবে। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে কোটা বাতিল হলেও তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির পদে কোটা ব্যবস্থা আগের মতোই বহাল থাকবে। এর আগে সরকারি চাকরিতে নিয়োগে ৫৬ শতাংশ পদ বিভিন্ন কোটার জন্য সংরক্ষিত ছিল। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ৩০ শতাংশ, নারী ১০ শতাংশ, জেলা ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ৫ শতাংশ, প্রতিবন্ধী ১ শতাংশ।
সরকারি আনুষ্ঠানিক চাকরির বাইরে শ্রমিক নারীর ক্ষেত্রে সংখ্যা বেশি থাকলেও তার বেতন এখনও পুরুষের থেকে কম। হোটেল, রেস্তোরাঁ, নিরাপত্তাকর্মী, ইটভাটা, চাতাল, নির্মাণ কাজে কর্মরত নারী শ্রমিকরা বেতন বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। তারা পুরুষদের তুলনায় শুধু কম বেতনই পাচ্ছেন না, কাজ পাওয়াও তাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। মালিকপক্ষের ভাষ্য অনুযায়ী, প্রধান কাজের বাইরে সহযোগিতামূলক ও অগুরুত্বপূর্ণ কাজে নেওয়া হয় নারী শ্রমিকদের। তাই তারা মজুরি কম পায়। তাদের দাবি, এসব খাতের মূল কাজগুলো পুরুষ শ্রমিকরা করে, বিধায় তাদের বেতন বেশি। যদিও কর্মঘণ্টা হিসাব করলে দেখা যাবে, সমপরিমাণ এবং কোনও কোনও ক্ষেত্রে নারীরা বেশি সময় কাজ করছে।
কোটা কেন এখনও জরুরি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ‘উই ক্যান’ এর নির্বাহী সমন্বয়ক জিনাত আরা হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ঐতিহাসিকভাবে নারীরা পিছিয়ে আছে। এখনও এমন কোনও ঘটনা ঘটেনি যে, তাদের কোটা উঠিয়ে দিতে হবে। কোনও একটা ক্ষেত্রে আমরা কোনও একটি সুনির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে কতদূর এগিয়ে নিতে চাই, সেই পরিকল্পনা থেকে কোটা নির্ধারণ হয়। সেসব ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষ সমান জায়গায় চলে আসলে তখন কোটা বন্ধের কথা আসে।’
নারী এখনও প্রযুক্তি সম্পৃক্ততায় পিছিয়ে, শিক্ষায় সার্বিকভাবে হার কম, সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর ভূমিকা সামান্য, রাজনীতিসহ সব অঙ্গনে সে পিছিয়ে আছে। এ রকমের চলতে থাকলে আমরা এসজিডি গোলের নির্ধারিত পৌঁছাতে পারবো না। যে সব দেশ কখনোই নারীকে এগিয়ে নিতে এই ধরনের উদ্যোগগুলো নেয়নি, তারা সূচকগুলো ছুঁতে পেরেছে— এমন কোনও উদহারণ নেই।
কোটা এখনও জরুরি কিনা প্রশ্নে নারীপক্ষের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য শিরিন হক বলেন, ‘সমতা ত্বরান্বিত করতে কোটার আইডিয়া আনা হয়। এটা একটা বিশেষ ব্যবস্থা। কোটা শুরু হওয়ার কয়েক দশক পার হয়ে যাওয়ার পরে, কোটা আরও বেশি সময় লাগবে বা লাগবে না, এক কথায় বলে দেওয়া সম্ভব না। বিশ্লেষণ করে দেখা দরকার— কোটার সুবিধা আসলে কোন শ্রেণীর নারীরা পেলেন। সবাই সমানভাবে এটার সুবিধা পেয়েছে কিনা। কোটা দিয়ে এখনও পুরোপুরি সমতা আনা সম্ভব হয়নি। সেদিক থেকে বাস্তবতা হলো কোটা দরকার। তবে আমার মনে হয়, সুবিধা কারা পাবে, সেটা একটু পুনর্বিবেচনা করা দরকার।’