প্রসঙ্গত, গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়, আর ১০ মার্চ প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু হয়। করোনায় আক্রান্ত হয়ে ২৪ ঘণ্টায় আরও ৪৭ জন মারা গেছেন। এখন পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়ে মোট মারা গেছেন চার হাজার ১৭৪ জন। আর ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে শনাক্ত হয়েছেন দুই হাজার ২১১ জন। এখন পর্যন্ত করোনায় মোট শনাক্ত হয়েছেন তিন লাখ ছয় হাজার ৭৯৪ জন।
গত ২৬ জুলাই কোভিড-১৯ প্রতিরোধে ও আক্রান্ত রোগীদের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা প্রদান নিশ্চিতকরণে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ এ পর্যন্ত জারিকৃত পরিপত্র, প্রজ্ঞাপন, আদেশ, নির্দেশনা ও যেসব কমিটি গঠন করা হয়েছে সেগুলোর কার্যক্রম বাস্তবায়ন অগ্রগতি তদারকি করতে একটি টাস্কফোর্স কমিটি গঠন করা হয়।
মন্ত্রণালয় জানায়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবকে (জনস্বাস্থ্য) আহ্বায়ক করে ৯ সদস্যের এই টাস্কফোর্সে রয়েছেন–স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের যুগ্মসচিব, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব (প্রশাসন), স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব (প্রশাসন), অর্থ মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব (প্রশাসন, অর্থবিভাগ), স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব (প্রশাসন, জননিরাপত্তা বিভাগ), স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক, রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (জনস্বাস্থ্য-১)।
টাস্কফোর্স স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে পরিপত্র, প্রজ্ঞাপন, আদেশ, নির্দেশনা ও যেসব কমটি গঠন করা হয়েছে তাদের কার্যক্রম বাস্তবায়নের অগ্রগতি তদারকি করবে, গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত অভিযোগ ও তথ্য পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করবে, বিভিন্ন কমিটির সিদ্ধান্তের সমন্বয় করবে, যেসব হাসপাতাল ও ল্যাবে কোভিড পরীক্ষা হয়, তাদের লাইসেন্স পরীক্ষা করবে এবং সরকার নির্ধারিত ফি যথাযথভাবে আদায় করা হচ্ছে কিনা সেটাও মনিটর করবে, যেসব হাসপাতাল ও ল্যাবে কোভিড পরীক্ষা হয় সেখানে পর্যাপ্ত জনবল ও পরীক্ষার যথাযথ সুবিধা রয়েছে কিনা সেটা যাচাই করবে এবং এসব বিষয় কমিটি দু’মাসে কমপক্ষে একবার সভা করবে।
দেশে করোনা প্রাদুর্ভাবের পর থেকে মন্ত্রণালয় এবং অধিদফতর এ বিষয়ে একের পর এক কমিটি করেছে। সর্বশেষ গত ২৮ জুন করোনাভাইরাস নিয়ে গঠিত হওয়া ১০ কমিটির পুনর্গঠন করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ নিয়ে মন্ত্রণালয় এবং অধিদফতরের করোনা বিষয়ক কমিটির সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল চল্লিশের বেশি। এত কমিটির কাজ কী, তা নিয়ে প্রশ্ন ছিল শুরু থেকেই। অনেক জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেছেন, দেশে করোনা বিষয়ক যত কমিটি হয়েছে, বিশ্বের কোথাও তা নেই।
সেসব কমিটিতে কাউকে কাউকে রাখা হয়েছিল তাদের সম্মতি ছাড়াই, এমনকি সংবাদমাধ্যমে কমিটিতে নিজের নাম দেখেও অনেকে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন, কেউ কেউ রয়েছেন একাধিক কমিটিতে। আবার কমিটি বিলুপ্ত হলেও সদস্যদের জানানো হয়নি, এমন ঘটনাও ঘটেছে। কমিটির সংখ্যা, কমিটির কাজ নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও সর্বশেষ গঠিত টাস্কফোর্সে কোনও জনস্বাস্থ্যবিদকে না রাখার বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা করছেন তারা। এমনকি স্বাস্থ্য অধিদফতরের একাধিক বিশেষজ্ঞ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যাদের এখানে রাখা হয়েছে তারা আমাদের থেকে তথ্য নেন, মতামত নেন। তাহলে তারা কী করে টাস্কফোর্সে থাকেন?’ প্রশ্ন করেন তারা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ)-এর মহাসচিব ডা. ইহতেশামুল হক চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কয়েকদিন আগে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় টাস্কফোর্স করেছে। এর সদস্যরা করোনা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবেন এবং করোনা নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা নেবেন। কিন্তু এই টাস্কফোর্সের মধ্যে একজন ব্যক্তিও টেকনিক্যাল না। তারা কী মনিটরিং করবেন আর কী ব্যবস্থা নেবেন সেটা আমি বুঝিনি।’
তিনি বলেন, ‘সারা দেশের বিভাগে ও জেলাভিত্তিক সমন্বয়ের জন্য আরেকটি কমিটি করা হয়েছে। সেই কমিটি বিভিন্ন জেলায় স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের এবং করোনার বিষয়ে তদারকি করবে। তখন বিএমএ’র পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, সেখানেও কোনও চিকিৎসক নেই। এ বিষয়ে তখন প্রশ্ন করা হলে মন্ত্রণালয় থেকে উত্তর দেওয়া হয়, “দুইজন যুগ্ম সচিব পদে থাকা চিকিৎসক সেখানে রয়েছেন।” কিন্তু তারা তো যুগ্ম সচিব হিসেবে কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন, চিকিৎসক হিসেবে নন।’
‘আমরা সেসব চিকিৎসককেই বিভিন্ন কমিটিতে রাখার জন্য বলি, যারা সেসব বিষয়ে অভিজ্ঞ এবং বিশেষজ্ঞ জ্ঞান রয়েছে যাদের। কিন্তু তাদের যুগ্ম সচিব যাকে চিকিৎসক হিসেবে আমাদের কাউন্টার দেওয়া হয়েছে তিনি চিকিৎসাবিজ্ঞানের বা তার চিকিৎসক অভিজ্ঞতার আলোকে কী কাজ করবেন, সেটা আমাদের বোধগম্য নয়।’ বলেন ডা. ইহতেশামুল হক চৌধুরী।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আমলানির্ভর টাস্কফোর্স অযৌক্তিক, গ্রহণযোগ্য নয় মন্তব্য করে জনস্বাস্থ্যবিদ ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘এরকম কমিটি আমরা শুরু থেকেই দেখছি। যেসব কমিটি কাজ করার উৎসাহ কয়েকদিন পরেই হারিয়ে ফেলে। সেটা খুব স্বাভাবিক। কারণ, এটা তাদের কাজ নয়।’
তিনি বলেন, ‘তাদের আরও বহু কাজ রয়েছে। তাছাড়া যিনি যেটা জানেন না তিনি কীভাবে সেটা মনিটরিং করবেন। তার তো এই সম্পর্কে জ্ঞান থাকতে হবে, তাকে জানতে হবে। তারা কেবল টেবিল-চেয়ার গুনতে পারবেন, ছোটখাটো ত্রুটি ধরতে পারবেন, কোন ওষুধের মেয়াদোত্তীর্ণ হচ্ছে–এসব কাজেই সীমাবদ্ধ থাকতে হবে তাদের।’
‘স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের দুই চোখ যা দেখতে পারবে অন্যদের ২০ চোখও সেটা দেখতে পারবে না’ উল্লেখ করে অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘একজন বিশেষজ্ঞ ১০ মিনিটে একটি হাসপাতালে ঢুকে যে চিত্র বুঝতে পারবেন, তারা সেটা সারাদিন থেকেও বুঝতে পারবেন না। এটা তাদের দোষ নয়, এর কারণ তারা এতে বিশেষজ্ঞ নন।’
এ বিষয়ে কথা বলতে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক এবং স্বাস্থ্য সচিবকে একাধিকবার কল দিয়েও তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।