স্বাস্থ্য অধিদফতরের একাধিক সূত্র বাংলা ট্রিবিউনকে জানায়, আগামীকাল (১৮ আগস্ট) এ সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্য, স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকসহ বেলা ১১টায় ‘নমুনা সম্প্রসারণ নীতিমালার খসড়া চূড়ান্তকরণ’ বিষয়ক বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। আর সেখানেই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসবে বলেও জানিয়েছে সূত্র।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, র্যাপিড টেস্টের অনুমোদন দেওয়া হলে তা করোনা রোগী শনাক্ত, মহামারিতে নেওয়া পরিকল্পনাসহ নানা নীতিনির্ধারণে সাহায্য করবে, বাড়বে রোগী সংখ্যাও। অ্যান্টিবডি পরীক্ষার মাধ্যমে জানা যায় করোনা থেকে যারা সুস্থ হয়েছেন তাদের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে কিনা। আর অ্যান্টিজেন পরীক্ষার মাধ্যমে দেখা হয় বর্তমানে রোগীর শরীরে করোনাভাইরাস রয়েছে কিনা।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের একাধিক সূত্র বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছে, ১৮ আগস্ট মঙ্গলবার র্যাপিড টেস্ট সম্পর্কে সিদ্ধান্ত আসতে পারে। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের পর এ সংক্রান্ত কার্যক্রম শুরু হবে। অধিদফতর সূত্র জানায়, র্যাপিড টেস্টের যৌক্তিকতা তুলে ধরে কী ধরনের র্যাপিড টেস্ট হতে পারে সে বিষয়ে গত ৭ জুন মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবনা পাঠায় স্বাস্থ্য অধিদফতর। গত নয় জুলাই এ বিষয়ে একটি খসড়া নীতিমালা করে সেটি মন্ত্রণালয়ে পাঠায় অধিদফতর। এর প্রেক্ষিতে তার ১০ দিন পর অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলীকে প্রধান করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আবার সেটি তাদের মতামতের জন্য পাঠায় এবং তাদের মতামতের জন্য ১০ কার্যদিবস ঠিক করে দেয়।
বিশেষজ্ঞ কমিটি গত ৪ আগস্ট তাদের মতামত পাঠায় মন্ত্রণালয়ে। এদিকে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরও তাদের এই সংক্রান্ত কাজ শেষ করেছে। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পেলেই ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর সে অনুযায়ী অ্যান্টিবডি-অ্যান্টিজেন কিট কেনার জন্য স্পেসিফিকেশন দেবে।
বিশেষজ্ঞ কমিটির দেওয়া খসড়া নীতিমালায় বলা হয়েছে, বিশ্বে করোনাভাইরাস সংক্রান্ত ল্যাবরেটরি পরীক্ষার অনেক উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ হয়েছে। সেসব দেশে প্রধান নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর অনুমোদনের ভিত্তিতে নানা দেশে সেগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে। বাংলাদেশেও কোভিড-১৯-এর রোগ নির্ণয়ে ল্যাবরেটরি পরীক্ষার সম্প্রসারণের জন্য নীতিমালার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।
গত ৩ জুন কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি করোনা শনাক্তে র্যাপিড টেস্টের জন্য সুপারিশ দেয়। তারা করোনা শনাক্তে এতদিন ধরে চলা আরটি-পিসিআর (রিভার্স ট্রান্সক্রিপটেজ পলিমারেজ রিঅ্যাকশন) পরীক্ষার সঙ্গে অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করার জন্য সুপারিশ করেন। সেখানে অ্যান্টিজেন পরীক্ষার পক্ষেও মত দেন বিশেষজ্ঞরা।
এ সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রধান অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, কাল আমাদের মিটিং রয়েছে। আমাদের যে প্রেজেন্টেশন রয়েছে সেটা দেবো। তারপর মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নেবে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) এবং এ বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. সানিয়া তহমিনা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাংলাদেশের সব জায়গায় এখন করোনা শনাক্ত করা খুব প্রয়োজন। যদিও সব জায়গাতে পিসিআর ল্যাবরেটরি স্থাপন করা বাংলাদেশের মতো দেশে কঠিন বিষয়। তাই অ্যান্টিজেন এবং অ্যান্টিবডি কম্বাইন্ড করে যদি উপজেলা পর্যন্ত পরীক্ষা সুবিধাকে সম্প্রসারণ করা যায়, তাহলে ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে এর আওতায় নিয়ে আসা যাবে। কোভিড রোগীকে দ্রুত শনাক্ত করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
পাশের দেশ ভারতের অনেক রাজ্যেই গত জুন মাস থেকে র্যাপিড অ্যান্টিজেন পরীক্ষা হচ্ছে উল্লেখ করে স্বাস্থ্য অধিদফতরের কোভিড-১৯ ল্যাবরেটরি পরীক্ষা সম্প্রসারণ নীতিমালায় (খসড়া) বলা হয়েছে, ভারতে নীতিনির্ধারণী সংস্থা ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চ (আইসিএমআর)-এর নীতিমালার সঙ্গে বাংলাদেশের ল্যাবরেটরি পরীক্ষা সম্প্রসারণ খসড়া নীতিমালার প্রস্তাবিত পরীক্ষাগুলোর পুরোপুরি মিল রয়েছে।
জানা গেছে, আইসিএমআর অ্যান্টিজেন কিটের অনুমতি দিলেও তাদের পরীক্ষায় দেখা গেছে, র্যাপিড অ্যান্টিজেনের প্রায় ৫০ শতাংশ ফলস নেগেটিভ আসতে পারে। তাই আইসিএমআর বলেছে, উপসর্গ থাকলে অ্যান্টিজেন পরীক্ষাতে নেগেটিভ এলেও তাকে আরটি-পিসিআর পরীক্ষা করাতে হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একটি কমিউনিটিতে কত মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন এবং সে আক্রান্তদের মধ্যে কতজনের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে এবং তাদের পুনরায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে কিনা সেটি নির্ণয় করা যাবে। রোগীর অবস্থা এবং অ্যাপিডেমিওলজিক্যাল গবেষণা, দুই জায়গাতেই র্যাপিড টেস্টের প্রয়োজন রয়েছে। একইসঙ্গে লকডাউন লিফটিং, পোশাক কারখানাসহ নানা অফিস আদালত খুলে দেওয়ার জন্য, স্বাস্থ্যকর্মীদের কী অবস্থা সেটা বোঝার জন্য, এমনকি ভ্যাকসিন টেস্ট করার জন্য অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে কিনা সেখানেও এর উপযোগিতা রয়েছে।
করোনা শনাক্তে চারটি পরীক্ষার তুলনামূলক বিবরণ
স্বাস্থ্য অধিদফতরের বিশেষজ্ঞ কমিটির করা কোভিড-১৯ নমুনা পরীক্ষার তুলনামূলক বিবরণ থেকে জানা যায়, আরটি-পিসিআর পরীক্ষাকে করোনা পরীক্ষার জন্য গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড বা সর্বোত্তম বলে ধারা হয়। সময় দরকার হয় পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা। করোনা পরীক্ষার জন্য এটাই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে। বর্তমানে এই পরীক্ষা পদ্ধতিই দেশে অনুমোদিত এবং চলমান। তবে অসুবিধার ভেতরে রয়েছে এটা ব্যয়বহুল, সময়সাপেক্ষ, কিট সহজলভ্য নয়, বিশেষায়িত এবং অনুমোদিত পরীক্ষাগার ছাড়া সম্ভব নয় এবং প্রশিক্ষিত জনবল দরকার হয়।
আরেকটি পরীক্ষা হচ্ছে সিবি ন্যাট (Cartridge Based Nucleic Acid Amplification Test) । এ পরীক্ষাটি মূলত যক্ষ্মা শনাক্তে ব্যবহৃত হয়। এতে সময় দরকার হয় এক ঘণ্টা। এই পরীক্ষাটিকেও উত্তম বলে ধরা হয়। ল্যাবরেটরিতে ঝুঁকি কম, তুলনামূলক সহজ ও প্রশিক্ষিত জনবলের প্রয়োজনও কম। অসুবিধা হিসেবে রয়েছে ব্যয়বহুল, কিটের দুষ্প্রাপ্যতা, বিশেষায়িত এবং অনুমোদিত পরীক্ষাগার ছাড়া সম্ভব নয় এবং একসঙ্গে বেশি নমুনা পরীক্ষা সম্ভব নয়।
অন্যদিকে ‘র্যাপিড টেস্ট’ বলে পরিচিত অ্যান্টিজেন এবং অ্যান্টিবডি টেস্ট। অ্যান্টিজেনভিত্তিক এ পরীক্ষাকে ‘ভালো’ বলে মন্তব্য করা হয়েছে। এটিও করোনাভাইরাস শনাক্তে ব্যবহৃত হয়। এতে সময় দরকার হয় ১০ থেকে ২০ মিনিট। এই র্যাপিড টেস্ট এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে অনুমোদিত ও প্রচলিত নয়। তবে ভারতে এটা শুরু হয়েছে। স্পেসিফিকেশন কমপ্লায়েন্স সনদ, ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরে মান যাচাই এবং ছাড়পত্র ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
কিন্তু র্যাপিড টেস্টের মধ্যে আরেকটি পরীক্ষা অ্যান্টিবডিভিত্তিক ( Rapid Diagnostic Test-RDT) মূলত করোনা শনাক্তে নয়, এ পরীক্ষা দিয়ে দেখা হয় ইতোমধ্যে কেউ করোনায় আক্রান্ত কেউ হয়েছেন কিনা এবং তার শরীরে এ বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে কিনা। বাকি তিন পরীক্ষাতে ন্যাসোফেরিঞ্জিয়াল সোয়াব বা নাকের শ্লেষ্মা থেকে নমুনা নেওয়া হলেও অ্যান্টিবডি পরীক্ষাতে নমুনা হিসেবে ব্যবহৃত হয় রক্ত এবং এতে সময় লাগবে ১০ থেকে ৩০ মিনিট। এটি ভারতে শুরু হলেও বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত অনুমোদন দেওয়া হয়নি। এ পরীক্ষাটিও স্পেসিফিকেশন কমপ্লায়েন্স সনদ, ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরে মান যাচাই এবং ছাড়পত্র ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা
কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা শুরু থেকেই একথা বলে এসেছি, এতদিন পরে এসেও সেটা করা হচ্ছে—এটা ভালো খবর।’ অ্যান্টিজেন পরীক্ষা খুব দরকার ছিল আরও আগে থেকেই মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘হাসপাতালগুলোতে রোগীদের ভোগান্তি কমবে এখন, চিকিৎসকসহ অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের আক্রান্ত হওয়ার হার কমে যাবে।’
স্বাস্থ্য অধিদফতরের সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘হাসপাতালের জরুরি বিভাগে গুরুতর রোগী এলে, তার কোভিড টেস্ট না থাকায় চিকিৎসা না দেওয়া, এমনকি এ অবস্থায় ওই রোগীর মৃত্যুর খবর পর্যন্ত আমরা পেয়েছি। অথচ মাত্র ১৫ মিনিটে র্যাপিড টেস্ট করা গেলে, পজিটিভ-নেগেটিভ যাই হোক না কেন, রোগীকে সে অনুযায়ী চিকিৎসা দেওয়া যাবে।’