এদেশে সাম্রাজ্যবাদী দাবা খেলা চলবে না: বঙ্গবন্ধু

ফিরে দেখা ১৯৭২বাংলাদেশে সাম্রাজ্যবাদী দাবা খেলা চলবে না বলে ঘোষণা দিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, বাংলাদেশকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির দাবার গুটিতে পরিণত হতে দেওয়া হবে না। এক শ্রেণির লোকের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এরা বিদেশি শক্তির টাকায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ভারত ও রাশিয়ার সঙ্গে আমাদের সম্পর্কে ফাটল ধরাতে ও বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছে।’ এদের সম্পর্কে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘একাত্তরের মার্চে তিনি যেমন স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন, তেমনই আবারও চক্রান্তকারীদের উৎখাতের জন্য আন্দোলন শুরুর ডাক দিতে পারেন।’

১৯৭২ সালের ৬ মে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এসব কথা বলেন। এদিন বঙ্গবন্ধুকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের আজীবন সদস্য হিসেবে বরণ করে নেওয়া হয়। এই উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি ভাষণ দেন। পরদিন ৭ মে দৈনিক বাংলায় এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

1স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সাহায্যের কথা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘এক কোটি লোক ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। দীর্ঘ ৯ মাস ধরে ভারত তাদের খাবার দিয়েছে, টাকা দিয়েছে, সর্বাত্মক সহায়তা করেছে।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ প্রশ্নে রাশিয়া নিরাপত্তা পরিষদে তিন-তিনবার ভেটো দিয়েছে। তারা সেটি না দিলে বাংলাদেশের মানুষের দুর্দশা আজও শেষ হতো না।’ বঙ্গবন্ধু দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ‘এসব দেশের বন্ধুত্বকে সন্দেহের চোখে দেখা কারও কারও বাতিকে পরিণত হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘কিছু সংখ্যক সরকারি কর্মচারীও এসব ব্যক্তির পেছনে রয়েছেন। যেসব বিদেশি শক্তির বলে বলিয়ান হয়ে এখানে এখন কৃষক-শ্রমিক রাজ কায়েমের স্লোগান তোলা হয়েছে।’ সেসব বিদেশি শক্তির স্বরূপ উদঘাটন করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বাঙালি জাতিকে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য এরাই বর্বর পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছিল। জাহাজে করে চট্টগ্রামে বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র এসে পৌঁছেছিল, সে সবই ছিল চীনের দেওয়া।’ বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘এই জাহাজটিকে পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কিন্তু চট্টগ্রাম শহরের মানুষের জন্য সেটি বিপজ্জনক হবে বলে এই পরিকল্পনা কার্যকরী হয়নি।’

ডাকসুর আজীবন সদস্য পদ গ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধুতিনি বলেন, ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে যারা সাহায্য-সহযোগিতা করেছিল, বাংলাদেশ সবসময় তাদের কথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করবে। কিন্তু তাদের কিছুতেই বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করবে না— যারা মুক্তিসংগ্রামের বিরোধিতা করেছিল। তারা যদি কোনোদিন নিজেদের ভুল বুঝতে পারে, তবে আমরা অবশ্যই তাদের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেবো এবং খোলা মনে তাদের গ্রহণ করবো।’ ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানিসহ যেসব দেশের জনসাধারণ আমাদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিল, বঙ্গবন্ধু তাদের সবাইকে ধন্যবাদ জানান। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘ভারতবিরোধী প্রচারণার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশে নতুন পতাকা ওড়াবার হুমকি দেওয়া হচ্ছে।’ এর বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি প্রদান করে তিনি বলেন, ‘এর ফলে জনসাধারণের মনে গভীরভাবে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হবে। এদেশের মানুষ এত ত্যাগ ও ক্ষতি স্বীকার করেছে বাংলাদেশের পতাকার জন্যই। এর কোনও পরিবর্তন তারা চায় না।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, এসব ব্যক্তি একদিকে ধর্মান্ধতা ছড়াচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথাও বলছে। একই মঞ্চে দাঁড়িয়ে তারা দুই বিপরীতধর্মী আদর্শ প্রচার করছে।’ দেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে চরম দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল জামায়াতে ইসলাম, নেজামে ইসলাম ও রাজাকাররা চরম বামপন্থীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

বঙ্গবন্ধু বলেন, শুধু বক্তৃতা-বিবৃতি বা সংবাদপত্রে দায়িত্বজ্ঞানহীন নিবন্ধ লিখে সমাজতন্ত্র কায়েম করা যায় না। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এ দেশে সমাজতন্ত্র কায়েম হবেই। প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে সরকার এরই মধ্যে মিল-কলকারখানা ও ব্যাংক জাতীয়করণ করেছে।’ এদেশে কোনোভাবেই আর পুঁজিবাদী মনোভাব গড়ে উঠতে দেওয়া হবে না বলে তিনি ঘোষণা করেন।

ডাকসু আয়োজিত সভায় বক্তব্য রাখছেন বঙ্গবন্ধু

ছাত্রসমাজের প্রতি

বঙ্গবন্ধু পড়াশোনায় মনোনিবেশে ছাত্রদের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘দীর্ঘ সংগ্রাম ও আন্দোলনে অনেক সময় নষ্ট হয়েছে। এবার আপনারা পড়াশোনা করুন।’ শৃঙ্খলার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে তিনি বলেন, ‘শৃঙ্খলা ছাড়া যোগ্য নেতৃত্ব কখনও গড়ে ওঠে না। সমাজের সব ক্ষেত্রেই যোগ্য ব্যক্তিত্বের এখন খুবই প্রয়োজন।’ গ্রামে মা-বাবার কাছে গিয়ে ছুটি কাটানোর আহ্বান জানিয়ে ছাত্রদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘তাদের উচিত মানুষের দুঃখ-দুর্দশা নিজের চোখে দেখা এবং তা দূর করার উদ্যোগ নেওয়া।’

এই অনুষ্ঠানেই বঙ্গবন্ধু ডাকসুর আজীবন সদস্য হন। এক অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সংসদের আজীবন সদস্যপদ প্রদান করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে তিনিই প্রথম ব্যক্তি, যাকে ডাকসুর আজীবন সদস্যপদ দেওয়া হয়েছিল।