শিক্ষার্থীদের চাঁদায় হয় মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন








চারুকলার শিক্ষার্থীদের বৈশাখী প্রস্তুতিইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত মঙ্গল শোভাযাত্রার জন্য সুনির্দিষ্ট কোনও বাজেট নেই। পহেলা বৈশাখে বাংলা নববর্ষের সবচেয়ে আকর্ষণীয় আয়োজন হিসেবে মঙ্গল শোভাযাত্রাকে ধরে নেওয়া হলেও সরকার থেকে এজন্য কোনও আর্থিক অনুদান নেওয়া হয় না। এই শোভাযাত্রার মূল আয়োজক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষক- শিক্ষার্থীরাও এজন্য কখনও সরকারের বা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মুখাপেক্ষী হয়েছেন বলেও শোনা যায়নি। এই অনুষদের সাবেক-বর্তমান শিক্ষার্থীদের চাঁদা, কখনও দরকার পড়লে শুভানুধ্যায়ীদের কিছু অনুদান আর জোশের শ্রম-ঘাম দিয়েই প্রতিবছর সম্পন্ন হয় মঙ্গল শোভাযাত্রার সব আয়োজন। শোভাযাত্রার জন্য তৈরি করা মঙ্গল পট ও দ্রব্যগুলো নিলামে বিক্রি করে মেটানো হয় ফান্ডের ঘাটতি অথবা লাভের ঘরে জমা পড়ে উদ্বৃত্ত। মোটেও বাণিজ্যিক উদ্যোগ নয়, মঙ্গল শোভাযাত্রাকে নিতান্তই আনন্দ এবং প্রাণের টান হিসেবে ভাবেন চারুকলার ছাত্র-শিক্ষকরা।



06-04-19-Charukala_Boishakh Preparation-4

যেহেতু বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে মঙ্গল শোভাযাত্রা, তাই এটিকে সার্বিকভাবে ফুটিয়ে তোলার জন্য সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ও আর্থিক সহায়তা দিতে চায়। কিন্তু, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আর্থিক সহায়তা নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেন না শিক্ষার্থীরা। অর্থের সঙ্গে যেহেতু প্রভাব জড়িত থাকে তাই সব ধরনের প্রভাব এড়াতে এবং নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী স্বাধীনভাবে মঙ্গল শোভাযাত্রার সব আয়োজন সাজাতে তারা সরকারি-বেসরকারি অনুদান থেকে মোটামুটি দূরে থাকেন।
জানা গেছে, প্রতিবছর চারুকলা অনুষদের একটি ব্যাচ এই উৎসব আয়োজনের দায়িত্ব পায়। এবারে আয়োজনের দায়িত্বে রয়েছে ২১তম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা। ‘মস্তক তুলিতে দাও অনন্ত আকাশে’ এই স্লোগানকে সামনে রেখে প্রতিবছর মতো এবারও জাঁকজমক পরিবেশে এ উৎসবের আয়োজনের প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা। নানা রকমের জিনিসপত্র তৈরি করে এ উৎসবে ভিন্নমাত্রা যোগ করা হয়। এসব জিনিস তৈরিতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থীরা।




06-04-19-Charukala_Boishakh Preparation-11সরেজমিনে দেখা যায়, পহেলা বৈশাখ উদযাপনের জন্য বিভিন্ন রকমের মুখোশ, পট ও আকৃতির জিনিস তৈরি করা হচ্ছে। এর পাশাপাশি বিক্রিও শুরু করতে দেখা যাচ্ছে তাদের। বিক্রি করছেন চারুকলা অনুষদের ২১তম ব্যাচের শিক্ষার্থী অদ্রিয়ন্তী রায় ঊর্মি। কথা হয় তার সঙ্গে। এখন কেমন বিক্রি হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এখন তো শুরুর দিকে। তাই কম বিক্রি হচ্ছে। তবে, শেষের দিকে বিক্রি বাড়বে। এছাড়া আমাদের প্রস্তুতিও সম্পূর্ণ হয়নি। এখন পর্যন্ত ১০ শতাংশ মুখোশ বানানো হয়েছে। প্রতিনিয়ত কাজ চলছে।’


06-04-19-Charukala_Boishakh Preparation-7এছাড়া মুখোশের সঙ্গে বানানো হচ্ছে পেঁচা, বাঘ-সিংহ, ময়ূর, ইঁদুর, হাঁস, ষাঁড়, প্রজাপতি, সূর্য ইত্যাদি প্রতীক। এসব জিনিস তৈরির নেতৃত্বে আছেন চারুকলা অনুষদের ২১তম ব্যাচের শিক্ষার্থী গৌরাঙ্গ বৈরাগী। তিনি জানান, প্রতীক তৈরির কাজ এখন পর্যন্ত ২০ শতাংশ শেষ হয়েছে।


06-04-19-Charukala_Boishakh Preparation-6আর্থিক বরাদ্দের বিষয়ে কথা হয় চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেনের সঙ্গে। তিনি বাংলা নববর্ষ উদযাপন কমিটির সদস্য-সচিব। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রার জন্য কোনও নিদির্ষ্ট পরিমাণ বাজেট নেই। শিক্ষার্থীরা নিজেদের উদ্যোগে মঙ্গল শোভাযাত্রার জিনিস তৈরি করে। তারপর সেগুলো বিক্রি করে বিনিয়োগ করা অর্থ তুলে থাকে। তবে, তাদের বিক্রির পরিমাণ ১০ লাখ টাকার কম হয় না। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাদের জন্য কোনও বাজেট বরাদ্দ থাকে না। যেহেতু এটি বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে, তাই সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় আর্থিক সহায়তা দিতে চেয়েছে। কিন্তু ছাত্ররা সেটি নেয়নি। তারা নিজেদের অর্থায়ন ও শ্রমে মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করে।’

06-04-19-Charukala_Boishakh Preparation-5বছরের পর বছর ধরে এই আয়োজনের সঙ্গে সম্পৃক্ত চারুকলা বিভাগের একজন সাবেক শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ‘মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজনে আমরা আমাদের মনের আনন্দটাই তুলে ধরি। রঙে-পটে মনের ভাবগুলোকে প্রকাশ করি। এসব কাজে ও শোভাযাত্রায় বর্তমানদের পাশাপাশি সাবেকরাও এসে আনন্দের সঙ্গে যোগ দেন। যার যে মত বা পথ থাকুক না কেন চারুকলায় সবাই শিল্পী এবং আনন্দময় জমাট পরিবেশে নিজেদের শিল্পসত্তাটাই ফুটিয়ে তোলায় নিবিষ্ট থাকেন। কেবল মূল থিমটা কী হবে বা আয়োজনের কলেবর কী হবে এসব বিষয় নির্দিষ্ট ব্যাচের কমিটি থাকে, তারা বসে ঠিক করে নেয়। তাদের নেতৃত্বে বাকিরা কাজ করে। এখানে সবাই সবাইকে সম্মান করেন, শোভাযাত্রার আয়োজন নিয়ে কারও মনে কোনও প্রশ্ন বা বিরোধ থাকতে দেখিনি। সবাই নিজেদের পকেট থেকে চাঁদা দেন। এটা আসলে বিনিয়োগ। শোভাযাত্রার আগে ও পরে তৈরি করা জিনিসগুলো বিক্রি করে ভালো টাকা পাওয়া যায়। যদি সরকারের কাছ থেকে অনুদান নেওয়া হয় তাহলে অনুদানের সঙ্গে রাজনীতিও ঢুকে পড়বে। হয়তো এটা এমন করো, ওটা কেন হলো এগুলোও ঢুকতে পারে। সে কারণে অনুদান নেওয়ার ভাবনাই নেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে। অনুদানও নেবো না, কিছুই নষ্ট হতেও দেবো না।’