ইসলামের প্রচার ও দাওয়াতের প্রসারে ওয়াজ মাহফিল হলেও বর্তমান সময়ে বক্তার ভাষা ও বিষয়ে সমসাময়িক উপকরণ যুক্ত হয়েছে। সাধারণত ধর্মের আঙ্গিক ধরে নীতিনৈতিকতার পাশাপাশি সামাজিক সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনা করা হলেও গত ১০ বছরে ওয়াজে যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন বিষয়।
চিন্তাশীল আলেমরা বলছেন, ‘হিন্দি ছবির প্রসঙ্গ টানার পাশাপাশি ওয়াজে গান গেয়ে শোনানো, ফারসি শে’রের (কবিতা) পরিবর্তে বাংলা ধর্মভিত্তিক সংগীত পরিবেশন, থেমে থেমে ইংরেজির ব্যবহার ও বিভিন্ন কারণে-অকারণে শোবিজ তারকাদের কেন্দ্র করে বিষোদ্গার বেড়েছে মাহফিলে। অনেক বক্তার তুলে ধরা তথ্য জেনে শ্রোতারা বিস্মিত হয়ে পড়েন। কোনও বক্তার মুখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হয়ে ওঠেন শাশুড়ি! এসব বয়ান নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হাসাহাসি (ট্রল) হয়।’
আলেমরা বলছেন, সাধারণত মাহফিলে যে কোনও একটি বিষয়কে সামনে রেখে বক্তব্য দেন বক্তা। প্রথমত, পবিত্র কোরআন শরিফের আয়াত পাঠ ও দরুদ পাঠ করে আয়াতের অর্থ বাংলায় অনুবাদ করে বক্তব্য এগিয়ে নেওয়া হয়। বক্তারা বক্তব্যের ফাঁকে ফাঁকে ফারসি শে’র বা কবিতাও পাঠ করতেন। এখন সেই চিত্র বদলে গেছে। মাহফিলে শ্রোতাদের সামনে নিয়মিত বিরতি দিয়ে ইংরেজি ভাষায় বক্তব্য দেন কয়েকজন বক্তা।
জ্যেষ্ঠ আলেম শোলাকিয়া ঈদগাহের খতিব মাওলানা ফরীদউদ্দীন মাসঊদ বলছেন, ‘এখন তো অনেক বক্তা ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ওয়াজ করেন। এজন্য ওয়াজ এখন বিনোদন হয়ে গেছে। বিনোদনের জন্য শ্রোতাকে আকর্ষণ করতে নানান কৌশল অবলম্বন করতে হয়। অনেক জায়গায় দেখলাম, গান গাওয়া শুরু হয়েছে। বড় বড় গায়কদের গান নকল করা হয়। তার মানে গান মুখস্থ করতে হয়েছে, গান শুনতে হয়েছে। না হলে কীভাবে গান গাইবে সে?’
ইউটিউবে অন্তত শতাধিক বক্তার ওয়াজ মাহফিল পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, কয়েক বছর ধরে ফারসি শে’র বা কবিতার বদলে যুক্ত হয়েছে ধর্মভিত্তিক সংগীত, বিশেষ করে জামায়াত ঘরানার আলেমরা বক্তব্যের ফাঁকে দলীয় আদর্শভিত্তিক শিল্পীগোষ্ঠীর গান পরিবেশনের সুযোগ দেন। ভাষা হিসেবে ইংরেজি ব্যবহার করছেন কয়েকজন বক্তা। কোনও কোনও বক্তা শুদ্ধ ইংরেজি না বলে মুখ বাঁকিয়ে ভুল শব্দে মানুষকে হাসানোর চেষ্টা করেন।
শ্রোতাদের উদ্দেশে আযহারীর প্রশ্ন, ‘আল্লাহ কী বলেন। আল্লাহ কী বলেন, মুসা কী বলেন? আল্লাহ বললো নোহ, মুসা বললো ইয়েস। এরপর আল্লাহ বললেন, ‘মুসা, আমি তিনবার নো নো বললাম, তুমি তিনবার ইয়েস বললা।’ মাওলানা আযহারী প্রায় প্রতিটি বয়ানে বাংলার সঙ্গে ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করেন।
ওয়াজ মাহফিলে নোয়াখালীর মাওলানা রফিক উল্লাহ আফসারী, আমীর হামজাসহ কয়েকজন বক্তা ইংরেজির ব্যবহার করেন নিয়মিত।
এ বছরের ২২ জানুয়ারি মারা গেছেন বাংলা গানের জনপ্রিয় সুরকার, গীতিকবি, গায়ক, মুক্তিযোদ্ধা আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। এর কিছুদিন পর তার প্রসঙ্গে মাওলানা আমীর হামজা বলেন, ‘কিছুদিন আগে একজন ওলি মইরা গেছে। বুলবুল, শয়তান কবরে এখন আপেল খাচ্ছে।’
বক্তাদের মুখে ব্যক্তিকে হেয় করার প্রবণতা প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক মুফতি মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানীর ব্যাখ্যা, ‘ইসলাম ব্যক্তিকে হেয় করাকে সমর্থন করে না। মানুষের রুচি তো নষ্ট হয়ে গেছে। বক্তাদের অনেকেরই জ্ঞানের গভীরতা ও ইসলাম নিয়ে ভালো লেখাপড়া নেই। সুর আছে, চাপা আছে, ব্যস বক্তা হয়ে যায়। এদের কাছ থেকেই এমন উল্টাপাল্টা সম্ভব। যাদের ইলমি গভীরতা আছে, তারা কিন্তু এমন বলেন না। শ্রোতাদের মধ্যে অনেকের মানসিকতা নেতিবাচক বললে তারা গ্রহণ করেন। তারা উপদেশ গ্রহণ করতে অনিচ্ছুক। সত্যিকার অর্থে উপদেশ নেওয়া ও গ্রহণ করার মানসিকতা এখন নেই বললেই চলে।’
বক্তাদের মধ্যে কয়েকজন গানের শিল্পীদের গান গেয়ে সেই শিল্পীদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেন। যেমন, মাওলানা ইলিয়াছুর রহমান জিহাদী প্রয়াত রকসংগীতের কিংবদন্তি আইয়ুব বাচ্চু, লোকগানের শিল্পী মমতাজ, নগরবাউল জেমসসহ অনেকের গান গেয়ে শোনান। শ্রোতারাও হাসাহাসি করেন।
কোনও বক্তা আবার মঞ্চে বসে চেয়ারে পা তুলে বলেন, ‘খেলা দেহামু আজকা।’ মাওলানা আবদুল খালেক শরীয়তপুরী নামে একজন বক্তা আছেন, যিনি ভাষা-শব্দে-অঙ্গভঙ্গিতে দর্শক হাসানোর জন্য অনেক পরিচিত। তিনি সাধারণ শিল্পীদের নিয়ে সুর তুলে বিষোদ্গার করেন নিয়মিত।
শুধু গানই নয়, আবদুল খালেক শরীয়তপুরীর আচরণও শ্রোতাদের অনেক বিনোদিত করে। নিজেকে ‘পাগল’ ঘোষণা করে একই ওয়াজে তিনি বললেন, ‘আজগা বেটা, খেলা দেহামু।’
* গিয়াস উদ্দিন তাহেরীর ওয়াজের লিংক:
* মুহাম্মদ শামীম রেজা ক্বাদেরীর ওয়াজের লিংক:
কোনও বক্তার নাম উদ্ধৃত না করেই তরুণ ইসলামি রাজনীতিক মাওলানা ওয়ালী উল্লাহ আরমান তাদের বর্জনের পরামর্শ দিয়েছেন। তার ভাষ্য, “এদের 'পেশাদার' কিংবা ভাড়াটে বক্তা বলা যেতে পারে। তাদের পরিচয় কমবেশি অনেকেই জানেন। তাদের বর্জন করা উচিত অথবা তাদের মুখে লাগাম দেওয়ার ব্যবস্থা করে মাহফিলে নেওয়া উচিত।”
রাজধানীর একটি মাদ্রাসার শিক্ষক মাওলানা ওয়ালী উল্লাহ আরমান বলেন, ‘ওয়াজ মাহফিলকে মাধ্যম বানিয়ে সুরেলা কণ্ঠ ও চটকদার বাচনভঙ্গির মাধ্যমে অনেক বক্তা নিজ স্বার্থসিদ্ধি যেমন করেন, আবার তাদের কারণে ক্ষেত্রবিশেষে ইসলামের মৌলিক বিষয় কখনও কখনও হাস্যরসে পরিণত হয়।’
মাওলানা সালাউদ্দীন জাহাঙ্গীর বর্তমান বক্তাদের ওয়াজ মাহফিল পর্যবেক্ষণ করে থাকেন। তরুণ এই লেখকের ভাষ্য, ‘অহেতুক বানোয়াট গল্প, তথ্যসূত্র ছাড়া মনগড়া কেচ্ছা কাহিনি, মানুষকে বিনোদন দিতে নাট্যাভিনয়, গান-বাদ্যের নকল করে লোক হাসানো—ওয়াজ-মাহফিল জমাতে এখন এসবই করে থাকেন অনেক ধর্মীয় বক্তা। এসব কারণে ওয়াজ-মাহফিল বা বক্তাদের ওপর থেকে আস্থা কমে যাচ্ছে মানুষের। তাছাড়া মাহফিলগুলো থেকে সমাধানমূলক কোনও কিছু পাচ্ছে না মানুষ। সঠিক তথ্যের নিরিখে মানুষ আধুনিক পৃথিবীতে ধর্মীয় বিভিন্ন সমস্যার সমাধান চায়। কিন্তু আমাদের দেশের কয়জন বক্তা আধুনিক ধর্মীয় বিষয়-আশয় নিয়ে বক্তব্য দিতে পারেন? সেই ইউসুফ-জুলেখার কাহিনি, নবী মুসা আর ফেরআউনের আধা সত্য আধা বানোয়াট কেচ্ছা, অতিলৌকিক মনগড়া গালগল্প—এসব শুনিয়েই তারা পার করছেন বছরের পর বছর।’
সালাউদ্দীন জাহাঙ্গীরের অভিযোগ, ‘অনেক ওয়ায়েজ কোনও ধরনের পড়াশোনা ছাড়াই ওয়াজের ময়দানে নেমে গেছেন। কণ্ঠে সুর, গলায় জোরালো তাকত আর লোক হাসানোর কায়দা-কানুন জানা থাকলেই হলো, বছর ঘুরতে না ঘুরতেই তিনি দেশের অন্যতম বক্তা বনে যান। তার সময় বরাদ্দ নিতে লাইন পড়ে যায় আয়োজকদের। অথচ খোঁজ নিলে দেখা যাবে, অনেক টাইটেলসমৃদ্ধ বক্তা শুদ্ধভাবে আরবিই পড়তে জানেন না।’
মাহফিলে বক্তাদের চিৎকার করার মধ্য দিয়ে ওয়াজের সময়ের একটি বড় অংশ চলে যায়। রাজধানী ঢাকার মোহাম্মদপুরে একটি খ্যাতনামা মাদ্রাসার শিক্ষক চিৎকার প্রবণতার কারণে ইতোমধ্যে সমালোচিত হয়েছেন। প্রতিটি ওয়াজের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তিনি চিৎকার করেন। মাওলানা সালাউদ্দীন জাহাঙ্গীরের ভাষায়, ‘এগুলো এক ধরনের স্টান্টবাজি।’
মাসিক নবধ্বনি’র নির্বাহী সম্পাদক জাহাঙ্গীর বলছেন, ‘বক্তা তার বক্তব্যে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলছেন, আমেরিকা হুঁশিয়ার...আগুন জ্বালিয়ে দিবো অমুকের গদিতে...বঙ্গোপসাগরে ভাসিয়ে দিবো অমুক দেশ...আর যদি এটা হয় তাহলে আমরা ওটা করে ফেলবো...বাংলার বুকে হেন করে ছাড়বো তেন করে ছাড়বো...ইত্যাকার বিভিন্ন হুমকি-ধমকি। অনেক সময় শ্রোতারা তার বিকট চিৎকারের কারণে ঠিকমতো বুঝতেই পারেন না উনি আসলে কী বলছেন। ওই বক্তা নিজেও জানেন না, তার সামনে যেসব শ্রোতা বসে আছেন তাদের অধিকাংশই বুঝে গেছে এই লোক অযথা ফাঁপর নিচ্ছেন। তিনি যা বলছেন সবই কথার কথা, ওয়াজের নামে কিছুক্ষণ গলার বাহাদুরি।’
মাওলানা জাহাঙ্গীরের প্রশ্ন, ‘ইসলাম কি গলা ফাটিয়ে চিৎকার করার জিনিস? মানুষের হেদায়েত কি বিকট চিৎকারের মাধ্যমে পাওয়া যাবে? অনেক বক্তা আছেন, যারা তাদের বয়ানে অযথা চিৎকার-চেঁচামেচি করেন। কেন করেন? আল্লাহর রাসুলের জীবনী পড়ুন, সাহাবিদের জীবনী পড়ুন, তৎপরবর্তী বড় বড় আলেম ও ইমামদের জীবনী পড়ুন, কেউ ধর্মের কথা এভাবে চিৎকার করে বলেননি। তাহলে ওয়ায়েজ বা বক্তারা চিৎকার করে ধর্মের কথা বলার রেওয়াজ কোথা থেকে আমদানি করলেন?’
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশের প্রবীণ আলেম ও হাদিসের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক মাওলানা আশরাফ আলি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চিৎকার করে যারা বক্তব্য দেন, তারা নকল আলেম। মন্তব্য করে এখানে কিছু হবে না। সামনাসামনি তাদের বোঝাতে হবে।’
আরও পড়ুন-